সান্যালের শেষের কথাগুলোতে কক্ষের আবহাওয়াটা যেন কেমন করুণ হয়ে ওঠে।
সান্যাল তাঁর ধুতির প্রান্ত দিয়ে উদগত অশ্রুকে মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, উনিশ বৎসর পূর্বে হঠাৎ একদিন কলকাতা থেকে চৌধুরীর চিঠিতে যখন জানলাম হেমের মৃত্যু হয়েছে, সে আর ইহজগতে নেই, সেদিনের কথা আমি ভুলবো না কিরীটীবাবু। হেমের অসুখের সংবাদ পূর্বেই চৌধুরীর চিঠিতে পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু সে যে অত শীঘ্র আমাদের মায়া কাটিয়ে তার এত সাধের সাজানো ঘর ফেলে ঐ বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে এ যেন সত্যিই আমার স্বপ্নাতীত ছিল। হেমের মৃত্যুর পর দুবার মাত্র এখানে আমি এসেছি। —এ বাড়িতে পা দিলেই যেন হেমের শত সহস্র স্মৃতি আমার কণ্ঠ টিপে ধরেছে, তাই হাজার ইচ্ছা হলেও এদিকে আর পা বাড়াইনি। আর পা দিয়েই বা কি হবে বলুন! যার সঙ্গে সম্পর্ক সে-ই যখন রইল না! আর চৌধুরীর কথাই বা কি বলবো, কি যে ভালবাসত ও হেমকে! হেমের অসময়ে মৃত্যুতে ও যেন একেবারে হঠাৎ অল্প বয়সেই দেহ ও মনে স্থবির হয়ে পড়েছিল। বাইরে থেকে অবশ্য বুঝবার উপায় ছিল না, ভিতরে ভিতরে একেবারে শুকিয়ে। যেন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটী ও বসন্ত সেনের মধ্যে একবার দৃষ্টি-বিনিময় হয় চকিতে, যখন সান্যাল হেমপ্রভার মৃত্যুর কথা বলছিলেন। কিন্তু কিরীটী বা বসন্ত সেন দুজনার কেউই সান্যালের কথার মধ্যে কথা বলে তাঁকে বাধা দিল না। সান্যালের বক্তব্য শেষ হতেই সহসা কিরীটী বলে ওঠে, একটা কথা সান্যাল মশাই, একটু আগে আপনার ভগ্নী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যে কথাটা বললেন, মানে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, তাই কি?
বিস্মিত সান্যাল কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
কিন্তু কানাইয়ের মার মুখে হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে সেটা কিন্তু, কিরীটী শেষটুকু বলতে বোধ হয় ইতস্ততই করে।
সান্যাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, কি শুনেছেন?
হেমপ্রভা দেবীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি এবং সকলে যা জানে কলকাতায়ও তাঁর মৃত্যু ঘটেনি।
সে কি! একই সঙ্গে বলতে গেলে প্রায় কথাটা উচ্চারণ করলেন সান্যাল ও দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
নিষ্ঠুর সত্যকে এবার অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবেই যাচাই করার প্রয়োজন। এতকাল যা ঘন রহস্যের অন্তরালে সকলের অজ্ঞাত ছিল আর তা থাকবে না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য অতীতের আর এক রহস্যকে লোকচক্ষুর সম্মুখে উন্মোচিত করল যেন অতর্কিতেই।
কালের বিধান।
কালস্রোতে যা নিশ্চিহ্ন হয়ে ধুয়ে-মুছে একবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলেই সকলে ভেবেছিল, আজ আবার কানাইয়ের মা তাকে বর্তমানের মধ্যে এনে উপস্থিত করেছে।
ক্ষণপূর্বে উচ্চারিত কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
কারো কণ্ঠ হতে এতটুকু স্বরও নির্গত হয় না।
বারেকের জন্য চকিত দ্রুত দৃষ্টি সঞ্চালনে কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল।
হ্যাঁ, গতকাল সেন মশাইয়ের সঙ্গেও ঐ কথারই আলোচনা আমরা করেছিলাম—কিরীটী আবার বলে।
এ কথা কি সত্য বসন্ত? এবারে প্রশ্ন করলেন সান্যাল বসন্ত সেনকে।
না, সত্য নয়। কঠোর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নায়েব প্রত্যুত্তর দিলেন।
নায়েব মশাই, কোন কিছু আপনার অজ্ঞাত বলেই তাকে একমাত্র সেই যুক্তিতেই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না। কালও আপনাকে এটুকুই বলবার চেষ্টা করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, কানাইয়ের মা মিথ্য বলেনি।
ডাক তো বসত ভায়া একবার ঐ ঝি কানাইয়ের মাকে। কথাটা বললেন সান্যালই এবারে।
হ্যাঁ, তাই ডাকুন, সত্যিই যদি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর ব্যাপারে কোন রহস্য থেকেই থাকে সেটাকে অতি অবশ্য যাচাই করা প্রয়োজন। লক্ষ্মীকান্ত যেন অতি উৎসাহের সঙ্গে কথাটা বললেন।
গোবিন্দ এই গোবিন্দ! বসন্তবাবু দরজার বাইরে গিয়ে ভৃত্য গোবিন্দকে ডাকলেন।
একটু পরেই গোবিন্দ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো, বাবু!
কানাইয়ের মাকে একবার ডেকে দে তো। যা শীগগির পাঠিয়ে দে এ ঘরে। গোবিন্দ আদেশ পালনের জন্য চলে গেল।
কিন্তু কানাইয়ের মার কথার সত্যতা যাচাই করার চাইতেও ঢের বিস্ময় সকলের জন্য অপেক্ষা করছিল, যখন গোবিন্দ এসে সংবাদ দিল সকাল থেকে কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আবার কিরে! ভাল করে। খোঁজ নিয়ে দেখ। কোথায় যাবে বুড়ী!
তীক্ষ্ণ রাগত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন বসন্ত সেন।
আজ্ঞে ভাল করেই দেখেছি। ঠাকুর আর বনমালীও বললে, সকাল থেকে অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি—
ঠিক এমনি সময় প্রথমে সবিতা ও তার পশ্চাতে সত্যজিৎ কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করলে।
সবিতার চোখমুখে একটা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সবিতা সকলকে সেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত দেখে, এমন কি দারোগা লক্ষীকান্ত সাহাকেও সেই ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট দেখে প্রথমটায় যেন একটু ইতস্ততই করে কিন্তু পরক্ষণেই সে সঙ্কোচটুকু কাটিয়ে উঠে ব্যগ্র কণ্ঠে বসন্ত সেনের দিকে তাকিয়েই বলে, নায়েব কাকা, সকাল থেকে এ বাড়ির মধ্যে কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!