কতদূর যাবেন আপনি মিস চৌধুরী?
সবিতা তার গন্তব্যস্থানের কথা বলতেই যুবক সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আশ্চর্য! আমিও তো একই জায়গার যাত্রী। আপনি কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর–
হ্যাঁ। আমি তাঁর মেয়ে, বলতে বলতে সহসা এতক্ষণে সবিতার দুচোখের দৃষ্টি অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে আসে নিজের অজ্ঞাতেই।
নিরুদ্ধ অন্তর-বেদনায় এতক্ষণ সবিতা ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছিল। সেই সন্ধ্যায় পিতার নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া থেকে এই পর্যন্ত একফোঁটা অশ্রুও তার চোখ দিয়ে পড়েনি।
সহসা সত্যজিৎ রায়ের প্রশ্নে সে যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরই কন্যা এই পরিচয় দিতে গিয়ে তার চোখের পাতা দুটো অশ্রুজলে ভিজে গেল।
সত্যজিৎ অবাক বিস্ময়ে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
পিতার পরিচয় দিতে গিয়ে হঠাৎ তার দুচোখের পাতা অশ্রুভারে টলমল করে উঠলো কেন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
আমার নামটা আপনি শুনেছেন কিনা মিস চৌধুরী জানি না, আমার বাবা সত্যভূষণ রায় আপনার বাবা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বাল্যবন্ধু। আপনার বাবার আমন্ত্রণ পেয়েই আমি বর্মা থেকে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।
সবিতা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। নিঃশব্দে সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ একপক্ষে ভালই হলো। গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের কাল প্রায় দ্বিপ্রহর হবে। দীর্ঘ পথে আপনাকে সঙ্গী পেয়ে মন্দ হলো না। পথের। একঘেয়েমিটা অনেকটা সহ্য হবে। সত্যি, কি আশ্চর্য যোগাযোগ দেখুন! বলতে বলতে মৃদু হাসে সত্যজিৎ।
সহসা একসময় সত্যজিৎ লক্ষ্য করে, তার এতগুলো কথার জবাবে একটি কথাও বলেনি এতক্ষণ সবিতা। একতরফা সে-ই কেবল এতক্ষণ বকবক করে চলেছে।
এবং শুধু তাই নয়, যদি দেখবার তার না ভুল হয়ে থাকে তো সবিতার চোখে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাসও লক্ষ্য করেছে।
নিজের কৌতুহলকে আর দমন করতে পারে না সত্যজিৎ। এবং কোন প্রকার ইতস্তত না করে সোজাসুজিই প্রশ্ন করলে, মাফ করবেন মিসু চৌধুরী, একটা কথা না বলে আর থাকতে পারছি না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ রকম চিন্তিত ও অন্যমনস্ক আপনি। পরস্পরের পরিচয় থেকে যখন জানা গেছে এতদিন আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও পরিচয়ের দাবী একটা উভয়েই আমরা উভয়ের কাছে করতে পারি, সেই পরিচয়ের দাবীতেই জিজ্ঞাসা করছি কথাটা। আশা করি মনে কিছু করবেন না।
না। আপনি হয়ত জানেন না মিঃ রায়, অতি বড় একটা দুঃসংবাদ পেয়েই আমি এই ট্রেনে দেশের বাড়িতে যাচ্ছি–
দুঃসংবাদ! বিস্মিত কণ্ঠে সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। আমার বাবা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, হঠাৎ নিহত হয়েছেন।
নিহত হয়েছেন! মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষে সত্যজিৎ তাকিয়ে থাকে সবিতার মুখের দিকে।
হ্যাঁ।
আর একটু স্পষ্ট করে বলুন মিস চৌধুরী, আমি যে আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
এর চাইতে বেশী আমিও কিছুই জানি না মিঃ রায়। বসন্ত কাকা তার করে কেবলমাত্র ঐটকুই আমায় জানিয়ে যেতে লিখেছেন।
কিন্তু
আমি নিজেও এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, কেমন করে এত বড় দুর্ঘটনাটা সম্ভব হলো! আমার অজাতশত্রু বাপকে কে হত্যা করতে পারে!
বাইরে থেকে একজন মানুষকে সব সময় সম্পূর্ণভাবে বিচার করা চলে না সবিতা দেবী। তাছাড়া আপনার বাবার মত অত বড় একটা জমিদারী চালাতে গেলে নিজের অজ্ঞাতেই দুএকজন শত্রু সষ্টি করা এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু সে-সব কথা পরে ভাবলেও চলতে পারে। সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে এখন তিনি নিহত হয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে আমি বা আপনি সে ব্যাপারে কতদূর কি করতে পারি
আমরা আর কি করতে পারি বা পারবো! কতকটা যেন হতাশাই সবিতার কণ্ঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই। আমাদের দুজনেরই অনেক কিছুই করণীয় আছে। আপনার পিতা এবং আমার পিতা বাল্যবন্ধু। আগে চলুন সেখানে পৌঁছই, তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিয়ে যেমন করেই হোক এ হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবারও তো অন্তত একটা চেষ্টা করতে পারি।
সত্যজিতের কথাটা সবিতা যেন ঠিক হদয়ঙ্গম করে উঠতে পারে না।
ও বুঝে উঠতে পারে না, ওরা দুজনে ওখানে গিয়ে পৌঁছেই বা কি করে তার পিতার হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করতে পারে।
কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তার পিতার মৃত্যু-রহস্যের মীমাংসা হোক বা না হোক, পথের মাঝখানে সত্যজিতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তার সরস মধুর কথাবার্তায় পিতার হত্যা-সংবাদে যে অসহনীয় দুঃখ তাকে একেবারে বিমূঢ় ও অসহায় করে ফেলেছিল তা থেকে ও যেন কতকটা সান্ত্বনা পায়।
অন্তত তার দুঃখের ভাগীদার যে নিঃসম্পর্কীয় হলেও একজন আছে, এ কথাটা জেনেও যেন ও মনের মধ্যে অনেকটা সান্ত্বনা পায়। অনেকটা নিশ্চিত হয়।
০২. নায়েব বসন্তবাবু
নায়েব বসন্তবাবু, নিজেই স্টেশনে এসেছিলেন সবিতা তার পেয়েই রওনা হবে এই আশা করে।
বসন্তবাবুর বয়স ষাটের কোঠা প্রায় পার হতে চললেও বার্ধক্য এখনো তাঁকে খুব বেশী কাবু করতে পারেনি।
চুলগুলো পেকে একেবারে সাদা হয়ে গেলেও শরীরের গঠন ও কার্যক্ষমতার মধ্যে কোথায়ও এতটুকু বার্ধক্যের ছায়া পড়েনি এখনো। তাঁর পেশল উঁচু লম্বা দেহের গঠন দেখলে মনে হয় দেহে এখনও তাঁর প্রচুর ক্ষমতা। এখনো তিনি দশ-পনের মাইল পথ অনায়াসে হেঁটে চলে যেতে পারেন।