পাবো বলেই তো আশা করে আছি। নচেৎ কোন দুঃসাহসে এ কেসটা আমি হাতে নিয়েছি বলুন তো?
কিন্তু দারোগা সাহেব, এদিকে চা যে জুড়িয়ে গেল! কথাটা বললে কল্যাণী।
ওঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক ঠিক। লক্ষ্মীকান্ত হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে একটা কাপ নিতে নিতে বললেন, এ কি, তিন কাপ চা যে!
কথাটার জবাব দেয় কিরীটীই, একটা কাপ ঐ সঙ্গে হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে নিতে, নায়েব মশাইয়ের বোধ হয় চা তেমন চলে না!
এবারে জবাব দিলেন নায়েবই, হ্যাঁ। এ-যুগের লোকদের মত চা-টা তেমন আমার ঠিক সহ্য হয় না। কিরীটীবাবু, ঠিকই বলেছেন।
চা খান না! আশ্চর্য তো! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত।
না। সকালে বিকালে চায়ের বদলে আমি এক লাস করে দুধ পান করি।
হ্যাঁ, ওঁর আমাদের মত বোধ হয় অসার বস্তুতে তেমন পক্ষপাতিত্ব নেই। উনি একেবারে খাঁটি ও সার বস্তুরই প্রিয়। হাসতে হাসতেই কিরীটী কথাটা উচ্চারণ করে এবং হাসতে হাসতেই কথাটা বললেও, আড়চোখে বসন্ত সেনের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে কিরীটী ভোলে না। নায়েবের চোখের তারা দুটো যেন বারেকের জন্য একবার ঝিকিয়ে উঠে আবার স্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেল, সেটুকুও তার নজর এড়ায় না।
বাইরে এমন সময় চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল। এবং সেই সঙ্গে গলাও শোনা গেল, বসন্ত ভায়া, কোথায় হে?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি যুগপৎ খোলা-পথের দিকে পতিত হয়।
এই যে সান্যাল মশাই আসুন। আসুন-আমি এই ঘরেই আছি। উদার কণ্ঠে আহ্বান জানালেন বসন্ত সেন।
১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল
কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন পরক্ষণেই। পরিধানে একটা সাদা ধুতি, গায়ে একটা মের্জাই। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।
আসুন সান্যাল মশাই। এদের সঙ্গে আপনার পরিচয়টা করিয়ে দিই। ইনি শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীকান্ত সাহা, এখানকার থানার বড়বাবু। ইনি মিঃ কিরীটী রায় রহস্যভেদী—আর ইনি—
নমস্কার, আসুন। আপনার পরিচয় আগেই আপনার কন্যা দিয়েছেন। লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের বক্তব্যে বাধা দিয়ে কথাটা বললেন।
বটে! বটে! মা কালই বুঝি আগেই আমার পরিচয় দিয়েছে? কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে বাপের পরিচয়—সেটা তো ঠিক পরিচয় পাওয়া হলো না দারোগা সাহেব! কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন সান্যাল।
কেন বলুন তো? প্রশ্ন করলেন লক্ষীকান্ত।
কেন আবার! অতিশয়োক্তিতে সে পরিচয় যে অনিবার্য ভাবেই দুষ্ট হবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকালে উঠে কোথায় গিয়েছিলে মা-জননী? আমার এখনো উপাসনা সমাপন হয়নি। প্রভাত-উপাসনার ব্যবস্থাটা করে দাও তো গিয়ে মা
এখনি যাচ্ছি বাবা। সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। কতকটা যেন লজ্জিত ভাবেই কথা কটি বলে কল্যাণী কক্ষ হতে একটু দ্রুতই নিক্রান্ত হয়ে গেল।
আপনি কালই এখানে এসে পৌচেছেন শুনলাম! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ। সংবাদপত্রে সব জানা মাত্রই চলে আসতে হলো। আপনার বলতে আজ আমি ছাড়া মেয়েটার আর কেউই তো নেই। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। ছেলেবয়সে মাকে হারাল, ত্রিসংসারে একমাত্র ছিল ঐ বাপ, তাকেও হারাল। খেদপূর্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সান্যাল মশাই।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের একজনও কেউই সান্যাল মশাইয়ের কথার কোন জবাব দিল না।
সকলেই নিঃশব্দে বসে রইল।
নিত্যানন্দই আবার কথা বললেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো দারোগা সাহেব! এ যে একেবারে অসম্ভব, অবিশ্বাস্য! এই অজ শহর, এখানেও এসব ঘটে! কিরীটীবাবু, কথা বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর দিকে ঘরে তাকিয়ে সান্যাল তাঁর বক্তব্যের শেষটুকু কিরীটীর উদ্দেশ্যেই যেন ব্যক্ত করলেন, আপনি তো শুনলাম একজন নামকরা বিচক্ষণ গোয়েন্দা, আপনিই বলুন না?
অসম্ভব হলেও ব্যাপারটা এইখানেই তো ঘটেছে মিঃ সান্যাল! জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
কিন্তু কে হত্যা করলো? আর তাকে হত্যা করেই বা কি লাভ?
দ্বিতীয় প্রশ্নটার আপনার জবাব পেলেই তো আপনার প্রথম প্রশ্নটার জবাবটাও আমরা পেয়ে যাই সান্যাল মশাই! এবারে জবাব দিল কিরীটীই, এবং সেটাই তো এক্ষেত্রে আমাদের তদন্তের মূল ব্যাপার!
কি জানি কিরীটীবাবু, ঘটনাটা সংবাদপত্র মারফৎ পড়া অবধিই যেন আমি একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন—
আমি চৌধুরীকে তো বেশ ভাল করেই জানতাম, অমন চরিত্রবান সহৃদয় লোক হয় না আজকালকার দিনে বড় একটা। তারপর কতকটা যেন স্বগত ভাবেই বললেন, দয়াময়, সবই তোমার লীলা প্রভু!
আমাদেরও তাই বক্তব্য সান্যাল মশাই। কিরীটী আবার কথা বলে, এ দুর্ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে এবং সেটা থাকতেই হবে। বিনা উদ্দেশ্যে বা বিনা কারণে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনো সংঘটিত হয় না। হতে পারে না। আপনি, বসন্তবাবু, আপনার দীর্ঘদিন ধরে নিহত মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে জানতেন। তাঁর সম্পর্কে আপনারা আমাদের যত সংবাদ দিতে পারবেন আর কারো পক্ষেই সেটা সম্ভবপর হবে না। এবং এ-ও সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে থেকেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বা মলবান সত্রের সন্ধান পাই যার সাহায্যে এই ধরনের তদন্ত-ব্যাপারে মীমাংসাটা সহজ ও সরল হয়ে আসে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কিরীটীবাবু, সান্যাল বলতে লাগলেন, এমন কোন ঘটনাই কই চৌধুরী সম্পর্কে আমার মনে পড়ছে না যেটা আপনাদের বললে আপনারা এ ব্যাপারে আলোর সন্ধান পাবেন, যে ঘটনাকে তার এইভাবে নিহত হবার সামান্যতম কারণ বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলেও আপনার যদি আমাকে বলেন ঠিক কি আপনারা জানতে চান চৌধুরী সম্পর্কে, তাহলে জানা থাকলে বলতে পারি কারণ সে যে আমার কতখানি আপনার ছিল সে একমাত্র আমিই জানি। আমার কোন মার পেটের বোন ছিল না কিরীটীবাবু। হেম আমার দূর-সম্পর্কীয় মামাতো বোন হলেও সহোদরারও অধিক ছিল। একই মায়ের স্নেহের অঞ্চলে সে ও আমি বর্ধিত হয়েছি। সে যে আমার কত খানি ছিল, বলতে বলতে প্রৌঢ় সান্যালের গলার স্বরটা রুদ্ধ হয়ে আসে— দুই চক্ষুর দৃষ্টি অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে ওঠে।