কিরীটীর হেয়ালি ভরা কথাগুলোর সঠিক অর্থ একেবারেই লক্ষ্মীকান্তর হৃদয়ঙ্গম হয় না। তথাপি সে জবাব দিতে পশ্চাৎপদ হয় না।
তা যা বলছেন, তবে কি জানেন মিঃ রায়, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে বেশ একটু জটিলই।
কেন বলুন তো?
কারণ এখানকার কোন স্থানীয় লোকই চৌধুরী মশাইকে হত্যা করেনি
তাই বুঝি!
নিশ্চয়ই, সে সম্পর্কে কোন ভুলই নেই। Some outsiders—আর আপনি কি মনে করেন খুন করার পর আর সে বেটা এ সহরের চতুঃসীমানায় আছে? সঙ্গে সঙ্গেই পগারপার হয়েছে।
হ্যাঁ।
তা হলেই বুঝুন। নচেৎ আমিই কি এত সহজে হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম নাকি! এতক্ষণে বেটাকে নিয়ে হাজতে পরতাম না!
চলুন না, ভিতরের ঘরে বসেই কথাবার্তা হবেখন। কথাটা বললেন নায়েব।
তাই চলুন। লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন।
নায়েব বসন্ত সেনেরই আহ্বানে অতঃপর সকলে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে নায়েবের কক্ষমধ্যেই এসে চকূলেন।
বসুন দারোগা সাহেব, কিরীটীবাবু, বসুন। মা-লক্ষী, তুমিও বোস। সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে বসন্ত সেন সকলকেই বসবার জন্য আহ্বান জানালেন।
সকলে উপবেশন করে।
একটু চা হবে তো দারোগা সাহেব? লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন প্রশ্ন করলেন।
চা! তা না হয় আনান!
বসন্ত সেন বোধ হয় চায়ের যোগাড় দেখতেই অন্দরের দিকে চলে গেলেন।
কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে এবার লক্ষ্মীকান্তই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না? আপনি?
কল্যাণী বোধ করি নিজের পরিচয়টা নিজেই দিতে যাচ্ছিল, কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, উনিও এখানে নবাগতা, মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছেন। সবিতা দেবীর মামাতো বোন। কল্যাণী সান্যাল।
মামাতো বোন! কই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কোন শ্যালক আছেন বলে তো সেদিন সবিতা দেবী কিছু বললেন না?
এবার জবাব দিল কল্যাণী নিজেই, মামাতো বোনই বটে, তবে তাঁর সঙ্গে ঠিক রক্তের কোন জোরাল সম্পর্ক নেই। আমার বাবা নিত্যানন্দ সান্যাল পিসিমার দূরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। এবং শুনেছি আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুরমার কাছেই নাকি তিনি মানুষ। আমাদের বাড়ি থেকেই পিসিমার বিবাহ হয়েছিল।
বেশ সহজ পরিষ্কার কণ্ঠে কল্যাণী লক্ষ্মীকান্তকে কথাগুলো বলে গেল। কল্যাণীর জবাব দেবার ভঙ্গী ও কথার চমৎকার বাঁধুনি কিরীটীকে কল্যাণীর প্রতি শ্রদ্ধান্বিতই করে তোলে। সংক্ষেপে সে লক্ষ্মীকান্তর যাবতীয় প্রশ্নেরই তখন উত্তর দিল।
লক্ষীকান্ত দারোগাও কল্যাণীর জবাবে তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না।
এমন সময় দেওয়ান বসন্তবাবু, আবার ঘরের মধ্যে ফিরে এলেন।
নায়েবকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে লক্ষ্মীকান্ত তাঁকেই এবারে প্রশ্ন করলেন, সেই ছোকরাটি, সত্যজিৎ না কি নাম, চৌধুরী মশাইয়ের বন্ধুপুত্র— চলে গিয়েছেন নাকি?
না, তিনি এখনো এখানেই আছেন। তাঁকে ডাকবো নাকি?
না, ডাকতে হবে না। হ্যাঁ ভাল কথা কিরীটীবাবু, আপনার পরিচয় হয়নি সেই ছেলেটির সঙ্গে?
কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়, হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি। কেন বলুন তো!
না, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম, ছেলেটিকে আপনার কেমন বলে মনে হয়?
চমৎকার! A perfect gentleman!
ভৃত্য একটা ট্রেতে করে চার পেয়ালা চা নিয়ে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।
তিনিই বোধ হয় সবিতা দেবীকে পরামর্শ দিয়ে আপনাকে এখানে আনিয়েছেন।
কিরীটী এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারে, হঠাৎ তার সত্যজিৎ সম্পর্কে ঐ ধরনের প্রশ্নটা করবার উদ্দেশ্য কি। লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে দুএকটি কথা বলবার পরই কিরীটী লক্ষ্মীকান্ত-চরিত্র সম্পর্কে কতকটা আন্দাজ করে নিতে পেরেছিল এবং এটাও সে বুঝতে পারছিল, স্পষ্টাস্পষ্টি ভাবে না জানালেও লক্ষ্মীকান্ত তার এখানে আগমনটা বিশেষ সুনজরের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। এ জগতে একশ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেদের অধিকারের সীমানা বা চৌহদ্দির মধ্যে তৃতীয় কোন ব্যক্তির মাথা গলানোটা আদপেই ভাল দৃষ্টিতে বা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কিরীটী মনে মনে একটু হাসে এবং অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্তর প্রশ্নের জবাব দেয়।
কতকটা তাই বটে, আবার সম্পূর্ণ সেটা না-ও বটে। কারণ সবিতা দেবীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেই বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, কারো কথা চট করে যে মাথা পেতে মেনে নেবেন ঠিক সে শ্রেণীর মেয়ে তিনি নন।
লোকচরিত্র সম্পর্কেও তো দেখছি বেশ আপনার অভিজ্ঞতা আছে কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ, লোকচরিত্র নিয়েই যখন কারবার করতে হয়, সে সম্পর্কে একটুআধটু জ্ঞান না থাকলে কি করে চলে বলুন? কিন্তু সেকথা যাক, লক্ষ্মীকান্তবাবু। আপনি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এতে যে কি আনন্দিত হলাম! আপনিই এলেন, নচেৎ গতকালই ভাবছিলাম আপনার সঙ্গেই যে সর্বাগ্রে আমার একবার দেখা করা প্রয়োজন–
কেন বলুন তো?
বলতে গেলে আপনিই তো এই শহরের দণ্ডমুখের খোদ মালিক। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে যা কিছু investigation তো আপনার দ্বারাই হয়েছে। কাজেই এর রহস্যের তদন্তে নামতে হলে আপনার সাহায্য ও উপদেশটাই তো সবপ্রথম কথা।
কিরীটীর কথা বলবার ভঙ্গিতে কল্যাণী এমন কি বসন্ত সেন পর্ন্তত ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারে না। কিরীটীর গণনায় ভুল হয়নি। সাপের মুখে ধুলো পড়ার মতই কাজ হলো, লক্ষ্মীকান্তর চক্ৰ গুটিয়ে এলো। বিনয় বিগলিত কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্ত জবাব দিলেন, হেঁ! হেঁ! কি যে বলেন আপনি কিরীটীবাবু? তবে হ্যাঁ, কেসটা জটিল হলেও আমার দিক থেকে যথাসম্ভব সাহায্য আপনি পাবেন।