তা একটু শক্ত বইকি। চোখ থাকলে এবং ইংরাজীতে যাকে আমরা সাধারণতঃ common sense বলি একটু প্রখর থাকলেই যে কোন রহস্যের solution-এ আসতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
তবে সকলে পারে না কেন?
কিরীটী কল্যাণীর কথায় এবারে হেসে ফেলল এবং হাসতে হাসতে বলে, আসল ব্যাপারটা কি জানেন? ধরুন আপনাকে একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। বলুন তো সবিতা দেবীর বাড়িতে একতলা থেকে দোতলায় উঠতে কটা সিঁড়ি আছে?
কটা সিঁড়ি! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল কল্যাণী কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বলুন না। আপনি কতবার ঐ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেছেন কাল থেকে?
তা কাল রাত্রে বারচারেক এবং আজ সকালে একবার।
পাঁচবার। তাহলে বলুন ঐ সিঁড়ি দিয়ে আপনি ওঠা-নামা করেছেন এবং দেখেছেনও সিঁড়িগুলো কেমন, না?
হ্যাঁ।
তাহলে বলুন কটা সিঁড়ি আছে?
এই পঁচিশ-ত্রিশটা হবে বোধ হয়।
উহু, একত্রিশটা সিঁড়ি আছে। তবেই দেখুন একই সিঁড়ির পথে আপনি ও আমি দুজনাই ওঠা-নামা করেছি। আমি সিঁড়ি-পথ দিয়ে আপনার মত কেবল ওঠা-নামাই করিনি, প্রথমবারেই ওঠবার সময় চারিদিকে ভাল করে সিঁড়িগুলোর অবস্থা দেখে মোট কতগুলো সিঁড়ির ধাপ আছে তাও গুনে নিয়েছি! এই হয়। আপনারা, কেবল সাধারণ লোকেরা দেখেনই, you only see but I observe! এইখানেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে তফাৎ। আমি বাড়িটার উপরতলার যাবতীয় খুটিনাটি সব বলতে পারি। চলুন রোদ চড়ে উঠেছে। এবারে ফেরা যাক।
চলুন।
দুজনে উঠে আবার প্রমোদভবনের দিকে চলতে শুরু করে।
কিরীটী এক সময় আবার পথ চলতে চলতেই কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, কথা হচ্ছিল আমাদের হত্যাকারীকে ধরতে পারবো কিনা? ধরতে পারবোই তবে বর্তমানে এখন আমার কেবল চারিদিক দেখবার ও কান পেতে শোনবার পালাই চলেছে। এরপর যা দেখবো শুনবো সব কিছু তার ভাবতে হবে এবং ভাবতে ভাবতেই আমার চোখের সামনে ক্রমে সব রহস্যের কুয়াশা ভেদ করে আলো ফুটে উঠবে যখন, তখনই আপনাকে আমি বলতে পারবো কবে ঠিক হত্যাকারীর কিনারা আমি করতে পারবো। তার আগে নয়।
আমাকে আপনার এই রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপারে সহকারিণী করে নেবেন মিঃ রায়?
বেশ তো। সহকারী যদি সত্যিকারের সহকারী হয় তাহলে কাজ করবার মধ্যেও যে একটা আনন্দ আছে।
কিরীটী হাসতে হাসতেই জবাব দেয়।
কিন্তু আমার সাহচর্য যদি আপনার কাজে বিঘ্ন ঘটায়?
বিঘ্ন ঘটাবে কেন? আপনার মনে যদি আমাকে আমার কাজে সত্যিকারের সাহায্য করবার ইচ্ছা থাকে তাহলে কি আর আপনি বিঘ্ন ঘটাবেন?
চলতে চলতে দুজনে প্রায় তখন প্রমোদভবনের মধ্যে এসে গিয়েছে। দুর থেকে দেখা গেল নায়েব গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পাশে লক্ষ্মীকান্ত দারোগা।
দুজনেরই দৃষ্টি একই সঙ্গে অদূরে গেটের সামনে দণ্ডায়মান লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও নায়েবের উপরে পতিত হল।
নায়েবের পাশে ঐ ভদ্রলোকটি কে মিঃ রায়? কল্যাণী কিরীটীকে প্রশ্ন করে।
চিনতে পারা তো কষ্ট নয় ভদ্রলোকটিকে মিস সান্যাল! কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
আপনি চেনেন না নাকি ওঁকে?
না, তবে ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে অনায়াসেই একটা অনুমান করে নিতে পারা যায় চেয়ে দেখুন। ভদ্রলোকের পরিধানে খাকি প্যান্ট ও খাকি হাফসাট।
তার থেকে কি প্রমাণ হলো?
প্রমাণ হচ্ছে এই যে, ভদ্রলোক বোধ হয় এখানকার থানা অফিসার, পুলিসের লোক।
বেশ তো আপনার যুক্তি! খাকি জামাকাপড় পরলেই পুলিসের লোক হবে নাকি? মিলিটারীর কোন লোকও তো হতে পারে?
এক্ষেত্রে তা নয় তার কারণ দুটো, এক নম্বর হচ্ছে মিলিটারী ড্রেস ঠিক অমনটি হয় না, দ্বিতীয়তঃ এই রকম জামায় ঐ পোশাক কেউ পরলে সে পুলিসের লোক হওয়ারই বেশী সম্ভাবনা
কথা বলতে বলতে ওরা দুজনে প্রায় লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও নায়েবের একেবারে কাছাকাছি ততক্ষণে এসে পড়েছে। নায়েব কথা বললেন কিরীটীকে সম্বোধন করে, এই যে মিঃ রায়, আসুন। বেড়াতে বের হয়েছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ।
আপনার জন্যেই ইনি অপেক্ষা করছেন। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি এখানকার থানা ইনচার্জ লক্ষ্মীকান্ত সাহা। আর এর কথা আপনাকে গতকাল আমি জানিয়েছিলাম চিঠি দিয়ে, ইনিই শ্রীযুক্ত কিরীটী রায়।
নমস্কার। লক্ষ্মীকান্ত কিরীটীকে নমস্কার জানায়।
নমস্কার। কিরীটী প্রতিনমস্কার জানাতে জানতে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তেরচাভাবে কল্যাণীর দিকে সকৌতুকে তাকায়।
কাল বসন্তবাবুর চিঠিতে আপনার এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আপনার সঙ্গে আলাপ করার লোভটা সম্বরণ করতে পারলাম না, মিঃ রায়। ছুটে এসেছি।
ধন্যবাদ। মৃদু নম্র কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
ওঁর মুখেই শুনলাম চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে নাকি তাঁর বাপের হত্যারহস্যের কিনারা করতে আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন?
না, এই তো সরে দিন দুই মাত্র এখানে এসেছি, এখনও তো সব চারিদিক ভাল করে দেখাশোনা করার সুযোগ পাইনি।
দেখাশোনা আর কি করবেন! লাশও তো সৎকার করে ফেলা হয়েছে। লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন।
তা তো ফেলতেই হবে, বাসি মড়া ঘরের মধ্যে রেখে আর লাভ কি বলুন? মিথ্যে কেবল দুর্গন্ধ ছড়াবে বই তো নয়! কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে আর দেখবেন কি?
যে কোন হত্যার ব্যাপারেই মৃতদেহটা তো শেষ পরিচ্ছেদ মাত্র লক্ষ্মীকান্তবাবু। প্রশ্নের অঙ্কের উত্তরমালা ছাপার অক্ষরে একটা সংখ্যাত্তর মাত্র। কিন্তু উত্তরটা জানলেই তো আর অঙ্কটা কষা যায় না। কি বলেন? হাসতে হাসতে কিরীটী কথাটা বলে।