অনেকটা কাছাকাছি হতে এবং দুজনের মধ্যে ব্যবধান কমে আসতেই তাকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো।
কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, অগ্রগামিনী আর কেউ নয়, সবিতার গত সন্ধ্যায় বিদেশাগত মামার মেয়ে কল্যাণী।
কল্যাণী একটু বিস্মিত দৃষ্টিতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটীও তাকিয়ে ছিল কল্যাণীর মুখের দিকেই।
পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি এখনো এবং কল্যাণী ইতিপূর্বে কিরীটীকে না দেখলেও কিরীটী গত সন্ধ্যাতেই দরজার ফাঁক দিয়ে কল্যাণীকে দেখেছিল, তাতেই তার কল্যাণীকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কিরীটীই প্রথমে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলে, সুপ্রভাত, আপনিই বোধ হয় কল্যাণী দেবী!
কল্যাণী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত কিরীটীর মুখে তার নিজের নামোচ্চারণ শুনে কতকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না ঠিক!
আমার নাম কিরীটী রায়। কিরীটী স্মিতকণ্ঠে জবাব দেয়।
ও, আপনিই কিরীটীবাবু! সবিতাদি কাল রাত্রে আপনার কথা বলছিল বটে। নমস্কার।
বেড়াতে বের হয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ। নতুন জায়গায় আমার তেমন ঘুম হয় না। সারাটা রাত বিছানার উপরে ছটফট করে ভেরের দিকে আর শুয়ে থাকতে ভাল লাগলো না। তাই বের হয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবের রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত, বাংলাদেশের এই শ্যামল রূপটি ভারী ভাল লাগছে।
দুজনেই আবার তখন পাশাপাশি চলতে শুরু করেছে সামনের দিকে। চলতে চলতেই কিরীটী কল্যাণীর কথার প্রত্যুত্তর দেয়, হ্যাঁ, এমন দেশটি আর কোথাও গেলে পাবেন না। বলতে গেলে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই আমি পর্যটন করেছি, কিন্তু বাংলার মাটিতে ও আকাশে যে মিষ্ট শ্যামল একটি অখণ্ড পরিপূর্ণতার সন্ধান পাই এমনটি আর কই চোখে তো আমার পড়ল না।
হয়ত আপনার কথাই সত্যি মিঃ রায়। বাংলাদেশের মেয়ে হলেও জন্ম আমার পাঞ্জাবে এবং বলতে গেলে এই আমার বাংলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
যত দিন যাবে দেখবেন এ দেশকে আপনার আরো বেশী করে ভাল লাগবে। ঋতুতে ঋতুতে আকাশে ও মাটিতে এর পরিবর্তন রংয়ের খেলা যেমন অপূর্ব তেমনি সুন্দর। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। যাকে নিত্য দেখেও আশ মেটে না।
পুব আকাশে একটু করে দিনের আলো যেন পাপড়ির মত দল মেলেছে।
রাস্তাটা নির্জন। ছোট ছোট লাল কাঁকর ছড়ানো রাস্তাটায়। জমিদারেরই তৈরী রাস্তাটা। গতরাত্রের বৃষ্টিতে রাস্তাটা এখনো ভিজে আছে। রাস্তার দুপাশে খোলা মাঠ—যেন সবুজ দুখানা চাদর দুদিকে বিছানো। ক্রমে একথা সেকথার মধ্যে দিয়ে দুজনার মধ্যে আলাপটা আরো বেশ জমে ওঠে। কিরীটীর কল্যাণীকে বেশ লাগে। মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বাংলার বাইরে পাঞ্জাবে মানুষ বলেই হয়ত কল্যাণীর স্বভাবে, কথাবার্তায় ও চালচলনে একটা সাবলীল গতি রয়েছে। বাংলাদেশের ঐ বয়েসী মেয়েদের মত লজ্জা বা আড়ষ্টতা এর চরিত্রের মধ্যে কোথাও নেই। কল্যাণীর চরিত্রে ও কথায়বার্তায় যে একটা সহজ সরলতা তাই নয়, তার দৈহিক গঠন ও স্বাস্থ্যের মধ্যেও একটা সুস্থ ও সহজ সৌন্দর্য আছে। রূপ বলতে যা বোঝায় কল্যাণীর তা না থাকলেও চেহারায় একটা সৌন্দর্য আছে—গায়ের রং কালোই কিন্তু তথাপি সেই কালোর মধ্যে এমন একটা স্নিগ্ধকর শ্যামল লাবণ্য আছে যেটা অতি সহজেই যেন অন্যের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চোখমুখের গঠনটিও কল্যাণীর ভারী চমৎকার। বাঁকানো ধনুকের মত ভ্রূ, ঘন আঁখিপল্লব, সজল স্নিগ্ধ দুটি চোখের তারা। পাতলা দুটি ওষ্ঠ। বাম গালের উপরে একটি তিল মুখের সৌন্দর্যকে যেন অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। কথায় কথায় চমৎকার হাসে কল্যাণী। এবং সেই হাসিটি যেন সমস্ত চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মেয়েটির কথাবার্তার মধ্যেও যেন একটা কৌতুকপ্রিয়তা বিদ্যমান।
সবিদি ও সত্যজিৎবাবুর মুখেই শুনেছিলাম আপনি নাকি একজন সাংঘাতিক বাঘা ডিটেকটিভ মিঃ রায়!
বাঘা ডিটেকটিভ! আর কি শুনেছেন বলুন তো মিস সান্যাল? হাসতে হাসতেই কিরীটী কল্যাণীকে প্রশ্ন করে।
আরো কত কি! সব কি ছাই মনে আছে? বলতে বলতে হঠাৎ কল্যাণী প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ রায়, সত্যিই কি আপনার মনে হয় আপনি পিসেমশাইয়ের হত্যাকারীকে ধরতে পারবেন?
রাস্তার একপাশে একটা বড় আকারের পাথর পড়েছিল। কিরীটী পাথরটার দিকে এগুতে এগুতে কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, আসুন মিস সান্যাল, ঐ পাথরটার উপরে কিছুক্ষণ বসা যাক।
বেশ তো! দু
জনে পাথরটার উপরে গিয়ে বসল।
পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগার সেটা থেকে টেনে নিতে নিতে কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে প্রশ্ন করে, ধুমপান করতে পারি? আপত্তি নেই আপনার?
Oh Surely, not at all!-মৃদু হাস্য-তরল কণ্ঠে কল্যাণী জবাব দিল।
সিগারটার দেয়াশলাই জালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে গোটা দুইতিন টান দিল কিরীটী। কল্যাণী পাথরটার সামনে থেকে একটা ঘাসের শীষ টেনে ছিড়ে দাঁত দিয়ে কাটতে লাগল অন্যমনস্ক ভাবে।
হঠাৎ কিরীটী আবার কথা শুরু করে, হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন আপনি মিস সান্যাল! হত্যাকারীকে ধরতে পারবো কিনা, তাই না?
হ্যাঁ, জানেন আমি একজন ডিটেকটিভ বইয়ের খুব ভক্ত! ঐসব তদন্তের ব্যাপারে আমার ভারী interest লাগে, ছোটখাটো সব অদ্ভুত সুত্র ধরে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা ভারী শক্ত কাজ, না?