সন্তোষ চৌধুরী সবিতার কথায় তার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তুমিই বোধ হয় সবিতা, কাকার মেয়ে? আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমার জাঠতুতো ভাই। এডেন থেকে আসছি, আমার নাম সন্তোষ চৌধুরী।
এডেন থেকে আসছেন?
হ্যাঁ। Its a long journey! সব বলবো, আগে একটু চা চাই বোন। তৃষ্ণায় গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। এমন হতচ্ছাড়া জায়গা যে স্টেশনে একটা চায়ের স্টল পর্যন্ত নেই। পরক্ষণেই সবিতার জবাবের অপেক্ষা মাত্রও না করে অদূরে দণ্ডায়মান ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে বললে, এই বেটারা, হাঁ করে ভূতের মত দাঁড়িয়ে দেখছিস কি! জিনিসগুলো উপরে নিয়ে চল না। I want some rest, ভীষণ tired!
কিন্তু তার কথায় কেউ কোন আগ্রহ জানায় না। যে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে থাকে।
সন্তোষবাবুর জিনিসপত্র নিচের মহলে আমার পাশের খালি ঘরটার রাখ। গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে বসন্তবাবু, বললেন।
নিচের মহলে থাকতে হবে মানে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সন্তোষ চৌধুরী বসন্তবাবুর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, নিচের ঘরেই আপনাকে থাকতে হবে যতক্ষণ না আপনার identity আমি সঠিকভাবে পাচ্ছি।
কঠিন স্বরে নায়েব বসন্তবাবু বলে ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন আর দ্বিতীয় কোন বাক্যব্যয় মাত্রও না করে।
বসন্তবাবুর খড়মের শব্দটা খটখট করে ঘরের বাইরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে যারা আর সকলে উপস্থিত ছিল, স্থাণুর মত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো।
শেষ নির্দেশ যেন জারী হয়ে গিয়েছে। এবং বসন্তবাবুর মুখনিঃসৃত সে নির্দেশের বিরুদ্ধে এ কক্ষের মধ্যে উপস্থিত কারো যেন এতটুকু ক্ষীণ প্রতিবাদ করবারও ক্ষমতা বা দুঃসাহস নেই, সেটকু বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না।
কক্ষের জমাট স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে প্রথমেই কথা বলল সন্তোষ চৌধুরী, তাহলে আমাকে নিচের ঘরে থাকতে হবে সবিতা? কথাটা বলে সন্তোষ সবিতার মুখের দিকে তাকাল।
ঘটনার পরিস্থিতিতে সত্যজিৎ নিজেকে যেন একটু বিব্রত বোধ করে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় সে।
সত্যিই যদি এই লোকটি একটু আগে যা বলল ঠিক হয় এবং এই চৌধুরীদের আত্মীয়ই হয়, তাহলে একে নিচের একটা ঘরে স্থান দিয়ে নিজের তার উপরের একখানা ঘর দখল করে থাকাটা নিশ্চয়ই শোভনীয় হবে না, ও সমীচীনও হবে না।
সত্যজিৎ এবারে কথা বললে, আমিই কেন নিচের একটা ঘরে এসে থাকি না
মিস চৌধুরী? উনি বরং
আপনি! বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সন্তোষ চৌধুরী এতক্ষণে সত্যজিতের মুখের দিকে।
আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না সন্তোষবাবু। আপনি এসেছেন এডেন থেকে আর আমি আসছি বর্মামুলুক—রেঙ্গুন থেকে।
এদের কোন আত্মীয় রেঙ্গুনে ছিলেন বলে তো কই জানি না! সন্তোষ চৌধুরী কথাটা বললে।
ঠিকই। আমি এদের আত্মীয় নই—
তবে?
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বন্ধুপুত্র। এদের গৃহে সামান্য কয়েকটা দিনের জন্য অতিথি মাত্র। শীঘ্রই চলে যাবো।
অঃ, একান্ত নিরাসক্ত ভাবেই সন্তোষ চৌধুরী শব্দটা উচ্চারণ করল।
আপাততঃ তো ওপরের কোন ঘর খালি নেই সন্তোষদা, আপনি বরং দুটো দিন কাকা যে ব্যবস্থা করে গেলেন নিচের ঘরেই থাকুন।
সবিতার কথায় যুগপৎ সকলেই যেন একটু বিস্মিত ভাবেই ওর মুখের দিকে তাকাল। গোবিন্দ, বাবুর জিনিসপত্রগুলো নায়েবকাকার পাশে যে ঘরটা খালি আছে, সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করে দাও। সবিতা এবারে কতকটা দৃঢ়কণ্ঠেই যেন তার বক্তব্যটা জানিয়ে দিল।
গোবিন্দ এগিয়ে এসে সন্তোষ চৌধুরীর মালপত্রগুলো মাটি থেকে তুলে নিতে নিতে বললে, চলেন বাবু
চল। সন্তোষের কণ্ঠস্বর ও মুখের চেহারাটা কেমন যেন অদ্ভুত শান্ত ও নিরাসক্ত শোনায়।
গোবিন্দ মালপত্রগুলো মাথায় তুলে নিয়ে ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়াল এবং সন্তোষ চৌধুরী তাকে অনুসরণ করল।
বসন্তবাবুর পাশের ঘরটা খালিই পড়েছিল।
ঘরটা স্বল্পপরিসর হলেও আলো-হাওয়ার প্রচুর ব্যবস্থাই আছে। জিনিসপত্রগুলো মেঝেতে নামিয়ে রেখে গোবিন্দ সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন বাবু, আগে একটা আলো জ্বেলে নিয়ে আসি।
গোবিন্দ ঘর হতে বের হয়ে গেল।
অন্ধকার ঘরটার মধ্যে একাকী সন্তোষ চৌধুরী দাঁড়িয়ে রইলো।
১০. পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী
পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরটা থেকে বের হয়ে বাইরের বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।
সন্ধ্যা থেকেই সারা আকাশটা জুড়ে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। শুরু হলো এতক্ষণে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবল হাওয়া।
মধ্যে মধ্যে কালো আকাশটার এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের নীল আলো যেন চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। গুরু গুরু মেঘের ডাক থেকে থেকে আকাশটাকে যেন কাঁপিয়ে তুলছে।
বারান্দাটা অতিক্রম করে কিরীটী বাইরের মহলের দিকে অগ্রসর হলো। ইতিমধ্যে বারান্দার ঝোলানো বাতি জেলে দেওয়া হয়েছে। প্রবল বায়ুর ঝাপটায় বাতিটা দুলছে। কাঁপছে বাতির শিখাটা। দেওয়লের গায়ে প্রতিফলিত আলোটাও সেই সঙ্গে কাঁপছে এধার থেকে ওধারে মৃদুমন্দ।
জলের ঝাপটা বারান্দাতেও আসছে—বেশিক্ষণ এই খোলা বারান্দায় থাকলে সর্বাঙ্গ ভিজে যাবে। সামনেই একটা ঘরের খোলা দ্বার দেখতে পেয়ে কিরীটী সেই ঘরের মধ্যেই গিয়ে ঢুকে পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ভারী গলায় প্রশ্ন এলো, কে?