সবিতা নিজেকে সামলে নিয়ে সান্যাল মশাইয়ের স্নেহের বাহুবন্ধন হতে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ধীরকণ্ঠে বলে, চলুন মামাবাবু, ঘরে চলুন।
চল মা।
কল্যাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে সবিতা তাকেও আহ্বান জানায়, এসো কল্যাণী।
প্রভু হে, দয়াময়! সবই তোমার ইচ্ছা! বলতে বলতে সান্যালমশাই সবিতা ও কল্যাণীকে অনুসরণ করে সবিতার ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই সবিতার ঘরের দ্বারপথে সত্যজিৎ এসে দাঁড়াল।
সহসা খোলা দ্বারপথে সত্যজিৎকে এসে দাঁড়াতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন সান্যালমশাই, এবং একবার সত্যজিতের দিকে তাকিয়ে নিমেষেই তার আপাদমস্তক এক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সবিতার দিকে ফিরে তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
সবিতা কোন প্রকার ইতস্তত মাত্র না করে সান্যালমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বাবার বন্ধুর ছেলে সত্যজিৎবাবু, বর্মা থেকে এসেছেন।
ও, তুমিই সত্যজিৎ-মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুপুত্র! মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে তোমার সম্পর্কে আমি সব কথাই শুনেছি। তা বেশ বেশ, কথাটা বলে এবারে সত্যজিতের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন, তা বাবাজীর এখানে কবে আসা হলো?
সবিতা দেবীর সঙ্গে একই ট্রেনে এখানে এসেছি। জবাব দিল সত্যজিৎ।
একই ট্রেনে আসা হয়েছে! তা বেশ বেশ! মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুপুত্র তুমি, এ বাড়ির পরমাত্মীয় বইকি। হ্যাঁ মা সবি, এর এখানে থাকতে কোন কষ্ট বা অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না, না, আপনি ব্যস্ত হবেন না মামাবাবু। প্রত্যুত্তর দেয় সত্যজিৎ।
সকলে এসে সবিতার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।
সত্যজিৎ একটা খালি চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে সান্যালমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন মামাবাবু।
সান্যালমশাই চেয়ারটার উপর উপবেশন করে একবার ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।
বসন্তর সঙ্গে দেখা হলো না—সে কি নেই? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন নিত্যানন্দ সবিতার মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বসন্তকাকা আছেন তো। সবিতা জবাব দেয়।
কই, নিচে তাকে দেখলাম না তো।
দুপুরের দিকে কাছারীতে গিয়েছেন, এখনো বোধ হয় ফেরেননি।
এমন সময় নীচে একটা উচ্চকণ্ঠের গোলমাল শোনা গেল। গোলমালের শব্দ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই কানে এসেছিল এবং সকলেই প্রায় উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।
ব্যাপার কি! নিচে এত গোলমাল কিসের? নিত্যনন্দই কতকটা যেন স্বগতভাবেই প্রশ্ন করলেন।
আমি দেখছি। সত্যজিৎ এগিয়ে যায়।
সবিতাও সত্যজিৎকে অনুসরণ করে।
নিচে বাইরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সত্যজিৎ ও সবিতা থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
অত্যন্ত দীর্ঘকায় মিলিটারী লংস ও বুসকোট পরিধান এক ভদ্রলোক উচ্চকণ্ঠে নায়েব বসন্তবাবুর সঙ্গে তর্ক করছেন। ঠাকুর, বনমালী, গোবিন্দ প্রভৃতি ভৃত্যের দল চারিদিকে দাঁড়িয়ে ভিড় করে।
আগন্তুকের দীর্ঘ বলিষ্ঠ গঠন প্রথমেই সকলের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। মুখখানা চৌকো। ছড়ানো চোয়াল।
মুখখানা দেখলেই মনে হয় যেন অত্যন্ত দৃঢ়বদ্ধ কঠিন ও কর্কশ। চোখ দুটো ছোট ছোট গোলাকার।
লোকটার সামনেই পায়ের কাছে একটা হোন্ডঅল স্ট্রাপ দিয়ে বাঁধা, একটা চামড়ার মাঝারি আকারের সুটকেস ও একটা এ্যাটাচী কেস।
আগন্তুক বসন্তবাবুকেই প্রশ্ন করছিল—আমার চিঠি পাননি মানে কি! এডেন থেকে পর পর দুদুখানা চিঠি দিয়েছি। এতদূর পথ এই বোঝা নিজের কাঁধে করে নিয়ে আসতে হয়েছে।
না, আপনার কোন চিঠিই পাইনি।
বেশ, চিঠি না পেয়েছেন না পেয়েছেন। চিঠিটা পেলে আর এমনি ঝামেলাটা আমাকে সহ্য করতে হতো না।
কিন্তু আপনার পরিচয় সম্পর্কে যখন আমি এতটুকুও জ্ঞাত নই, তখন এ বাড়িতে আপনাকে আমি উঠতে দিতে পারি না। নায়েব বসন্ত সেন বললেন।
বটে! উঠতে দিতে পারেন না। আমার পরিচয়টা পাবার পরও নয়?
না। দঢ়কণ্ঠে বসন্তবাবু, প্রত্যুত্তর দেন।
তাহলে আপনি বলতে চান যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আমার কাকা ছিলেন না? অর্থাৎ সোজা কথায় আমি তাঁর ভাইপো নই? কিন্তু এ কথাটাও কি কখনও আপনি শোনেননি কাকার মুখে যে, তাঁর এক বড় জাঠতুতো ভাই ছিল শশাঙ্কশেখর চৌধুরী এবং ১৮ ১৯ বৎসর বয়সের সময় তিনি ভাগ্যাণ্বেষণে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান? আপনি তো শুনি বহুকাল এ-বাড়িতে আছেন। এ কথাটা কখনো কাকার মুখে শোনেননি?
শুনেছি। শুনেছি তাঁর এক জাঠতুতো ভাই ছিল কিন্তু
তবে আবার এর মধ্যে কিন্তুটা কি?
কিন্তুটা যথেষ্ট আছে বৈকি। গম্ভীর দৃঢ় সংযত কণ্ঠে বসন্তবাবু, এবারে বললেন, আপনি সন্তোষ চৌধুরী যে সেই গৃহত্যাগী শশাঙ্কশেখর চৌধুরীরই একমাত্র পুত্র তার তো কোন প্রমাণ দেননি, একমাত্র আপনার কথা ছাড়া।
What do you mean! আমার কথা ছাড়া মানে কি? আমার কথার কি কোন মূল্যই নেই? আপনি তাহলে বলতে চান I am an imposter– প্রতারক!
মিথ্যে আপনি চেচাচ্ছেন মশাই। গলাবাজি করে এ প্রশ্নের মীমাংসা হতে পারে না। আপনার কাছে কোন লিখিত-পড়িত প্রমাণ আছে কি, যার সাহায্যে আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে আপনিই সেই শশাঙ্কবাবুর পুত্র সন্তোষ চৌধুরী, এই চৌধুরী বংশেরই একজন।
তাও আছে বৈকি! প্রয়োজন হলে আদালতেই সেটা আমি পেশ করবো, আপনাকে নয় অবশ্যি, ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিল সন্তোষ চৌধুরী।
সবিতা এতক্ষণ নিঃশব্দ বিস্ময়ে ওদের পরস্পরের কথা-কাটাকাটি শুনছিল। কিন্তু চুপ করে থাকতে পারল না, একটু এগিয়ে এসে বললে, কে এই ভদ্রলোক কাকাবাবু?