কিন্তু সত্যিকারের culprit বা দোষীকে ধরিয়ে দেওয়াও তো নাগরিক হিসাবে আপনার একটা মহৎ কাজ বা কর্তব্য।
তা ঠিক আমার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত নয় সত্যজিৎবাবু। এককালে একটা মোহ ও vanity বশেই এ lineয়ে হাত দিয়েছিলাম। বুদ্ধির খেলায় একজনকে ধরাশায়ী করতে একটা অপূর্ব পুলক অনুভব করতাম। ক্রমে সেটা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন নেশাটা এসেছে থিতিয়ে।
কেন?
তার কারণ দেখতে পাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তথাকথিত ঐ সব ভিলেনের দল অপরাধই করে বটে, তবে অপরাধের artটাকে জানে না।
অপরাধের আর্ট?
হ্যাঁ। আর্ট বলতে অবশ্য এক্ষেত্রে আমি এখানে ভিলেনের চাতুরীটাকেই mean করেছি। বলাই বাহুল্য আপনার ব্যাপারটা সে পর্যায়ে পড়ে না, কারণ আপনার কাছ হতে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা শুনে আমার যতদূর মনে হচ্ছে, হেমপ্রভা চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপার দুটো একসূত্রে তো গাঁথা নয়ই, হত্যাকারীও এক নয়।
সত্যজিৎ যেন একটু বিস্মিত হয়েই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় এবং বলে, কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে দুটো মৃতদেহ একই জায়গায় পাওয়া গেল কেন? Why peculiar coincidence!
ঘটনার পারম্পর্য বা সামঞ্জস্য এক এক সময় এরকম অদ্ভুত ঘটতে দেখা যায় সত্যজিৎবাবু, কিন্তু দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে একই হত্যাকারী প্রথম হত্যার পর দ্বিতীয়বার হত্যা করবে এটা আদপেই স্বাভাবিক নয়।
কিন্তু
সত্যজিৎবাবু, time factor is a very important factor! আমাদের দেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে, হত্যাকারী একটা ক্ষণিক উত্তেজনার মুহূর্তেই হত্যা করে বসে। পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে সব situationকে closely watch করে হত্যা করে না। অবশ্য একেবারেই যে হয় না তা আমি বলতে চাই না, কারণ নজিরের অভাব নেই। যেমন ধরুন পাকুড় মার্ডার কেস, ভাওয়ালের মধ্যম কুমারকে হত্যার প্রচেষ্টা প্ল্যান করেই এবং সময় নিয়ে ঐ সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু ভেবে দেখলেই এবং সমগ্র ঘটনাকে ভালভাবে পর্যালোচনা করে দেখলে বুঝতে পারবেন সেরকম কিছু নয়। প্রথমটা দ্বিতীয়টাকে follow করেনি, তবে দ্বিতীয় হত্যাটা প্রথম হত্যাটার cause বা কারণ হতে পারে। সে যাক। এ ধরনের মতামত প্রকাশ করবার আগে আমাদের অনেক কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য এ ব্যাপারে জানা প্রয়োজন। এবং আরো অনেক কিছু বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন। অর্থাৎ যাকে আমরা তদন্তের ব্যাপারে findings বলি—সব এখনও আমাদের হাতে তো আসেনি।
তাহলে কবে আমরা রওনা হচ্ছি মিঃ রায়?
শুভস্য শীঘ্রং! আজই রাত্রের গাড়িতে হলেই বা ক্ষতি কি?
বেশ তো, তবে সেই রকম ব্যবস্থাই করি।
করুন।
অতঃপর সত্যজিৎ তখনকার মত কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাত্ৰোত্থান করে।
০৯. কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ
কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ রাজবাটিতে পৌঁছবার পরের দিনই সন্ধ্যার দিকে নিত্যানন্দ সান্যাল মশাই তাঁর কন্যা কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে এসে পৌঁছলেন।
স্টেশনে জমিদারবাড়ির টমটমই সান্যালমশাইকে আনতে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার অন্ধকার সবে তখন চারিদিকে ঘন হয়ে এসেছে। প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে বাতি জলে উঠেছে।
সত্যজিতের ঘরেই কিরীটী তার থাকবার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল।
সত্যজিৎ পাশের ঘরে সবিতার সঙ্গে কথা বলছিল, আর কিরীটী একা ঘরের মধ্যে একটা আরামকেদারার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে একটা চুরোটে অগ্নিসংযোগ করে মধ্যে মধ্যে ধূমোদগিরণ করছিল।
সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল এবং সেই সঙ্গে শোনা গেল গম্ভীর মোটা গলার ডাক, সবি! আমার সবি মা কই!
কণ্ঠস্বর শ্রুতিপটে প্রবেশ করা মাত্রই কিরীটী সহসা যেন নিজের অজ্ঞাতেই আরামকেদারাটার উপরে সোজা হয়ে উঠে বসে।
পায়ের শব্দ ক্রমেই সিঁড়ি-পথে উপরের দিকে উঠে আসছে।
সবিতাও বোধ হয় সে কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল এবং ঘর থেকে বাইরে বারান্দায় বের হয়ে এসেছিল।
কিরীটীও উঠে এগিয়ে যায় খোলা দরজাটার দিকে।
এবং নিজের অস্তিত্বকে গোপন রেখেই ইচ্ছা করে দরজার খোলা কবাট দুটো ভেজিয়ে দিয়ে ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের বারান্দায় দৃষ্টিপাত করে।
সিঁড়ির মাথাতেই আগন্তুক নিত্যানন্দ সান্যালের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল এবং সবিতা নীচু হয়ে নিত্যানন্দর পায়ের ধুলো নিতে যেতেই নিত্যানন্দ পরম স্নেহে প্রসারিত দুই বাহুর সাহায্যে সবিতাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মধুসিক্ত করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, থাক মা থাক, হয়েছে—হয়েছে।
কণ্ঠস্বরটা সান্যালমশাইয়ের অশ্রুতে যেন বুজে আসে, চোখের কোলেও দুফোঁটা জল চকচক করে ওঠে বোধ হয়।
সবিতার মাথাটা সান্যালমশাই নিজের প্রশস্ত বক্ষের উপর ন্যস্ত করে ধীরে ধীরে ওর মাথার চলে সস্নেহে অঙ্গুলি-সঞ্চালন করতে থাকেন।
বারান্দার যেটুকু আলো সান্যালমশাইয়ের চোখে-মুখে পড়েছিল, সেই আলোতেই কিরীটী দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে, অন্তরের রুদ্ধ শোকাবেগটা সামলাবার জন্য সান্যালমশাই যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সান্যালমশাইয়ের মেয়ে কল্যাণীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কল্যাণী সবিতার চাইতে বছর চারেকের ছোট হবে বলেই মনে হয়। মেয়েটি কালো দেখতে হলেও সে কালো রূপের মধ্যে অপূর্ব একটা শ্ৰী আছে। মেয়েটির মুখখানির যেন এক কথায় তুলনা হয় না। ছোট কপাল, কপালের উপর কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল এসে পড়েছে; দুচোখের দৃষ্টিতে অপূর্ব একটা বুদ্ধির দীপ্তি যেন ঝকঝক করছে।