সেই সন্ধ্যা থেকেই আকাশে মেঘ করে আছে, একটা থমথমে ভাব।
সবিতা গাড়ির খোলা জানলা-পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ যেন শ্বাস নেবার অবকাশ পায়।
ভাল করে একবার ভেবে দেখবার চেষ্টা করে সমগ্র ব্যাপারটা আগাগোড়া।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী– তার বাবা। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল আর ইহজগতে নেই।
বাড়ি গিয়ে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই দেউড়ি পার হয়েই কাছারী বাড়ির দালানে তাঁর সেই সৌম্য প্রশান্ত চেহারাটা আর চোখে পড়বে না।
সস্নেহ মধুর সেই হাসি দিয়ে কেউ আর অভ্যর্থনা জানাবে না, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো মা! গাড়ি ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছেছিল?
প্রত্যেকবার ছুটিতে যাবার পর প্রথম দর্শনে কেউ আর বলবে না, তুই হাতমুখ ধুয়ে চা খা, আমি এখনি আসছি সবু!
ও আর কাউকে প্রত্যুত্তরে আব্দার-ভরা কণ্ঠে বলবে না, দেরি করো না বাবা, এখুনি এসো কিন্তু। তুমি এলে তবে দুজনে একসঙ্গে বসে চা খাবো। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে কিন্তু–
না রে না। আসছি, তুই যা—
এগিয়ে যেতে পিছন থেকে আর ও শুনতে পাবে না বাবার গলা, বসন্ত, আজ আমাকে ছুটি দাও। নকাইচকাই এসেছে, আজ ওর অনারে আমার ছুটি।
ওকে আদর করে বাবা নকাইচকাই বলে ডাকেন।
নকাইচকাই ওঁর আদরের ডাক।
ওর চার বছর বয়সে মা মারা গিয়েছেন। বাবার কাছেই ও মানুষ। মাকে ওর কিছুই মনে নেই।
বাবার শোবার ঘরে শিয়রের ধারে মায়ের এনলার্জড ফটোটার দিকে কতবার ও অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু কিছুই মনে করতে পারেনি। মা! মায়ের স্মৃতিটা এমন অস্পষ্ট!
মা-বাপ বলতে ঐ একজনকেই চিরদিন জেনে এসেছে। কি শান্ত চরিত্রের মানুষ ওর বাবা! লোকে বলত অজাতশত্রু।
অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির জমিদার হলেও কাউকে একটা চড়া বা উঁচু, কথা বলেননি। উদার শিশুর মত প্রকৃতি তার বাপের। কে শত্রুতা করে হত্যা করলে, নায়েব কাকা বসন্তবাবু তার বিশেষ কিছুই জানাননি, কেবল টেলিগ্রামে লিখেছেনঃ
Baboo Mahashaya killed! Come sharp!
Killed! নিহত!
কে-ই বা তাঁকে হত্যা করলে এবং কেনই বা তাঁকে হত্যা করলে!
ব্যাপারটা আগাগোড়া কিছুই যেন এখনো সবিতা বুঝে উঠতে পারছে না।
মেল ট্রেন।
এখন বেশ জোরেই চলেছে। লোহার চাকার একঘেয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দটা শ্রবণকে পীড়িত করে তোলে।
আকাশে ইতিমধ্যে একসময় কখন মেঘটা বেশ চাপ বেঁধে ঘন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কয়েকটা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ওর চোখেমুখে এসে পড়তেই ওর চমক ভাঙল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের সোনালী আলোয় মেঘাবৃত আকাশটা যেন ঝলকিয়ে উঠছে।
সবিতা ঘরে বসে গাড়ির কামরার মধ্যে দৃষ্টিপাত করল।
উপরের দুটো বার্থ ও নিচের দুটো বার্থ অধিকার করে ইতিমধ্যে কখন একসময় চারজন যাত্রী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।
দুজন তারা এখনো কেবল জেগে।
সে ও সর্বশেষের আগন্তুক যাত্রী সেই তরুণ যুবকটি। যুবকটির সঙ্গে কেবলমাত্র একটি মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস ও হোল্ডলে বাঁধা একটি বেডিং।
বেডিংটা এখনো সে খোলেনি। তারই গায়ে হেলান দিয়ে সুটকেসটার উপরে জুতোসমেত পা দুটো তুলে দিয়ে কামরার আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে কি একটা মোটা ইংরাজী বই পড়ছে।
সবিতা কতকটা অন্যমনস্কভাবেই তার ঠিক সামনেয় মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট, পাঠরত একমাত্র জাগ্রত তরুণ সহযাত্রীটির দিকে তাকাল।
বছর সাতাশ-আটাশ হয়ত বয়স হবে ওর। দোহারা লম্বা গড়ন।
চোখেমুখে অর্থাৎ মুখের গঠনে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা যেন ফুটে বের হয়।
তৈলহীন রুক্ষ লম্বা চুলগুলো কামরার মধ্যস্থিত ফ্যানের হাওয়ায় কপালের উপর এসে থেকে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাঁ গালের উপরে একটা দীর্ঘ গভীর ক্ষতচিহ্ন।
হঠাৎ ভদ্রলোকের বার্থের উপরে রক্ষিত চামড়ার সুটকেসটার উপরে নজর পড়ল সবিতার।
সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।
বাংলায় লেখা সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।
রেগুন! সত্যজিৎ রায়! কথা দুটির মধ্যে কোথায় যেন একটা পরিচয়ের ইঙ্গিত রয়েছে।
খুব বেশী দিনের কথা নয়। মাত্র বৎসরখানেক আগের কথা।
বাবার মুখে ইদানীং অনেকবার রেঙ্গুনে অবস্থিত ঐ নামটির উল্লেখ ও শুনেছে।
বাবার ছোটবেলার বন্ধ, সত্যভূষণ রায়ের একমাত্র ছেলে, সত্যজিৎ রায়। বিলেত-ফেরত ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনীয়ার। সঙ্গে সঙ্গে আবার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা নিহত হয়েছেন। বাবা নিহত হয়েছেন কেবল এই কথাটাই ও নায়েব কাকার তারবার্তায় জেনেছে, তার চাইতে বেশী কিছু ও জানতে পারেনি এখনো পর্যন্ত।
নিজের চিন্তার মধ্যেই সবিতা আবার তলিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠের সম্বোধনে চমকে মুখ তুলে তাকাল।
রাত বারোটা বাজে, ঘুমোবেন না? প্রশ্নকারী সম্মুখের মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট যুবক।
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় সবিতা।
কিন্তু আপনার তো দেখছি সঙ্গে কোন বেডিং পর্যন্ত নেই! যুবক স্মিতভাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।
সত্যি! এতক্ষণে সবিতার খেয়াল হয়। তাড়াতাড়িতে বেডিংটা পর্যন্ত সঙ্গে আনেনি সবিতা।
অবিশ্যি আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে যা বেডিং আছে সেটা শেয়ার করে নিতে পারি।
না, তার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি—
আপনি হয়ত ভাবছেন আমাকে আপনি বিব্রত করবেন! কিন্তু মোটেই তা নয় মিস।
আমার নাম সবিতা চৌধুরী।