পরিষ্কার সহজ কথায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
কে হত্যা করল এমন করে স্বামী ও স্ত্রী–মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও হেমপ্রভাকে।
একই লোকের হাতে কি স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিহত হয়েছেন!
কিন্তু এই বা কেমন? একই দিনে তো সেই সময় দুজনকেই হত্যা করা চলতে পারত?
একজনকে হত্যা করবার পর দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে আর একজনকে হত্যা করবার কারণটা কি! প্রয়োজন কি ছিল এই দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে প্রতীক্ষা করবার!
তবে কি একই হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেনি? দুজন হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেছে? হত্যাকারী দুজন!
হত্যার কারণ উভয় ক্ষেত্রেই কি এক, না বিভিন্ন! বিভিন্ন কারণ হলেও অকুস্থান সেই বকুল বৃক্ষতল হল কেন?
একটার পর একটা চিন্তা সত্যজিতের মাথার মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে লাগল।
দুটি হত্যাই একই সূত্রে গাঁথা, না একটির সঙ্গে অন্যটির আদৌ কোন সম্পর্ক নেই! সম্পূর্ণ বিভিন্ন! কেবল ঘটনাচক্রে দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটা অদ্ভুত পারম্পর্য এসে গিয়েছে মাত্র!
জট পাকিয়ে গিয়েছে দুটি হত্যা-রহস্য একত্র।
হত্যা-রহস্য দুটি যতই পাক খেয়ে খেয়ে জট পাকিয়ে তোলে, সত্যজিতের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা জিদ চেপে যায়।
মীমাংসা যতই সুদূরপরাহত বলে মনে হয়, মনের মধ্যে ততই যেন আরো তীব্র করে ও একটা রহস্যের হাতছানি অনুভব করে।
কানাইয়ের মা যে বলতে চায় এর মধ্যে কোন অপদেবতার কাণ্ডকারখানা আছে, তা ও বিশ্বাস করে না এবং যুক্তি দিয়েও মানতে পারে না।
অশিক্ষিতা কানাইয়ের মার কাছে যেটা সম্ভবপর বলে মনে হয়েছে, সত্যজিতের কাছে সেটা একেবারে সম্ভবপর বলে মনে হয় না।
মনে হয় একটিবার কলকাতায় যেতে পারলে বোধ হয় ভাল হতো। সেখানে গিয়ে কোন ভাল ডিটেকটিভের সন্ধান করে তাকে যদি এই কাজে নিযুক্ত করা যেত, হয়ত সহজেই এই রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছনো যেত।
ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ দ্বীপের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। দ্বীপের মধ্যে যে বিরাম কুটীর, সেটা একটা একতলা পাকা বাড়ি।
রৌদ্র বৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটাকে পুড়িয়েছে ও ভিজিয়েছে। বাড়িটার আসল রং কবে পড়ে ঝলসে ধুয়ে মুছে গিয়েছে।
দেওয়ালের গায়ে ছাদের কার্নিশে ধরেছে ফাটল আর সেই ফাটলের মধ্যে নির্বিবাদে বেড়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থের গাছগুলো।
জানলার কবাটগুলো কোনটা কবজার সঙ্গে ঝুলছে, কোনটার একটা পাল্লা বন্ধ করা, কোনটার দুটো পাল্লাই হা-হা-করছে খোলা। মধ্যে মধ্যে হাওয়ার মরিচা-ধরা কবজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা যায়। রং চটে গিয়েছে।
চারিদিকেই একটা হতশ্রী অযত্ন অবহেলার ছবি।
বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে এককালে যে চমৎকার একটি ফুলের বাগান ছিল, বিগত দিনের সেই সৌন্দর্য-সৃষ্টির ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন আজও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, দৈন্য অবহেলায় বুনো আগাছায় সমাকীর্ণ হয়ে।
সেই গোলাপ, গন্ধরাজ, যুঁই, চামেলীর সমারোহ কাঁটালতা ও বুনো ফুলের পর্যাপ্ততায় লজ্জায় যেন মুখ ঢেকেছে।
এই হয়ত সেই চৌধুরীদের নন্দনকানন। চৌধুরীবাড়ির আদরিণী বিলাসিনী বধুদের অলক্তরাগরঞ্জিত চরণের নূপুরনিক্বণে অতীতে হয়ত একদিন এই নন্দনকানন শব্দমুখরিত হয়ে উঠত।
অন্তঃপুরের সলজ্জ বধূটি হয়ত এখানে আপন খেয়াল-খুশিতে অবাধ স্বচ্ছন্দ গতিতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কখনো হয়ত কোন ফুলগাছের সামনে দাঁড়িয়ে ডাল থেকে ফুলটি ছিড়ে আপন কবরীতে লীলাভরে গুঁজে দিয়েছে।
আজ তারা কোথায়?
এই ভগ্ন বিরাম কুটীরের কক্ষের বায়ুতরঙ্গে কি তাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়?
সম্মুখে ছোট অপরিসর একটি বারান্দা এবং বারান্দার সামনেই পর পর তিনখানা ঘর।
পর পর তিনটি ঘরের মধ্যেই গিয়ে প্রবেশ করল সত্যজিৎ। ঘরের মেঝেতে একপর্দা ধুলো জমে আছে। কতদিন এখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি কে জানে!
০৭. কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই
কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই সকালবেলায় চা-পান করতে করতে সবিতার কাছে বললে, আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে মিস চৌধুরী, তাহলে কলকাতায় একজন ভাল ডিটেকটিভকে এনগেজ করে আসি এ ব্যাপারে!
আমিও গত রাত থেকে ঐ কথাই ভাবছিলাম সত্যজিৎবাবু। কিন্তু নায়েবকাকাকে কি একটিবার জিজ্ঞাসা করে তাঁর মতামত নেওয়া উচিত নয়?
সত্যজিৎ সবিতার প্রশ্নের জবাবে বলতে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই। তাঁকে অবশ্যই একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে বৈকি, কিন্তু তার পূর্বেই ঘরের দরজার উপরে নায়েবমশাইয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিসের মতামত মা সবি?
উভয়েই চমকে ফিরে তাকাল।
পায়ে হরিণের চামড়ার চটিজুতো থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নায়েব বসন্ত সেন একেবারে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন
এবং ওদের পরস্পরের আলোচনার শেষ কথাগুলো শুনতে পেয়েছেন, এরা। টেরও পায়নি।
এই যে নায়েবকাকা, আসুন! সবিতাই আহ্বান জানাল।
কর্তার শ্রাদ্ধের যোগাড় তো এবারে দেখতে হয়, সেই ব্যাপারেই একটা পরামর্শ করবার জন্য তোমার কাছে আসছিলাম মা। কিন্তু একটু আগে কি যেন মতামতের কথা বলছিলে মা!
সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে একবার পলকের জন্য দৃষ্টিপাত করে।
তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বলে, বলছিলাম নায়েবকাকা, বাবার এই মৃত্যুর কথাটা একটু ইতস্ততঃ করে সবিতা আবার বলে, ব্যাপারটাকে আমরা এত সহজে ভুলে যাব কেন?