উনিশ বছর পূর্বে যে হত্যাকাণ্ড (?) সংঘটিত হয়েছিল এবং উনিশ বছর পরে মাত্র কয়েকদিন আগে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল, আছে কি তার মধ্যে কোন যোগাযোগ! দুটি হত্যাকাণ্ডই কি একই সূত্রে গাঁথা, না একের সঙ্গে অন্যের কোন সম্পর্ক নেই!
ক্ষণপূর্বে কানাইয়ের মার বর্ণিত অতীতের সুদীর্ঘ কাহিনী হতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে একটা মস্ত বড় রহস্য জড়িয়ে আছে এবং যে রহস্যের মূলটা হয়ত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিন্তু কে করবে সেই অতীতের যবনিকাকে উত্তোলন?
কেমন করে উদঘাটিত হবে সত্যিই কোন অতীত রহস্য যদি এই হত্যাকাণ্ডের মূলে থাকেই, সেই অবশ্য প্রয়োজনীয় সত্যটুকু!
অতীতের কথা কানাইয়ের মা যতটুকু জানত বলেছে।
আর এ বাড়িতে বহুদিনকার পুরাতন লোক কে আছে? বনমালী। আর আছেন এদের নায়েব বসন্ত সেন।
কিন্তু বসন্ত সেনের মুখ থেকে কি কোন কথা বের করা যাবে?
বিশেষ করে পরশু রাত্রের আলোচনার ব্যাপারে তিনি যেন একটু তার উপরে অসন্তুষ্টই হয়েছেন বলে ওর ধারণা।
এক্ষেত্রে কোন কথাই হয়ত তিনি বলবেন না।
কিন্তু কেনই বা বলবেন না, পরক্ষণেই মনে হয় কথাটা সত্যজিতের, তার উপরে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তো কি!
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে তাঁরও তো কম interest থাকবার কথা নয়! আর কেবল interestই বা কেন, কর্তব্যও তো একটা আছে। এবং সব কিছুর উপরে নায়েব বসন্ত সেনের এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা!
আত্মীয় বন্ধু বা অভিভাবক বলতে সবিতা দেবীর একমাত্র উনিই—বসন্ত সেন।
নিকটতম আত্মীয়ের পর্যায়েই আজ উনি সবিতা দেবীর পড়েছেন।
হ্যাঁ, তাঁকেই আরো ভাল করে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে অতীতের কোন কথা যা হয়ত একমাত্র উনি ব্যতীত আর কেউই জানেন না।
তাছাড়া একবার ঘুরে দেখে আসতে হবে বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটি।
ঐ দ্বীপই হচ্ছে অকুস্থান।
মনের মধ্যে সহসা কেমন যেন একটা অদ্ভুত প্রেরণা ঐ মুহূর্তেই অনুভব করে সত্যজিৎ। বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটা যেন অদ্ভুত ভাবেই ওর মনকে আকর্ষণ করতে থাকে।
সত্যজিৎ আর দেরী করে না।
মস্ত বড় একটা প্রাঙ্গণ পার হয়ে একটা সরু অন্ধকার অলিন্দ মত, সেই অলিন্দেরই শেষপ্রান্তে যে দরজাটা সেটা খুলতেই সত্যজিতের চোখে পড়ল, বিলের জলে বড় বড় পাথর ফেলে, মাটি ও কাঁকর বিছিয়ে পায়ে চলা রাস্তাটা বরাবর দ্বীপের সঙে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে।
এটি যেন প্রমোদভবন ও দ্বীপের সংযুক্ত একটি সেতু।
রাস্তাটি জল থেকে মাত্র হাতখানেক উঁচু।
বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো, দুদিকটা ক্রমশঃ ঢালু হয়ে জলের মধ্যে নেমে গিয়েছে।
দীর্ঘ কয় বৎসরের জলের স্পর্শে পাথরগুলোর বুকে সবুজ শ্যাওলার একটা আস্তরণ পড়েছে। যেন সবুজ মখমলের একখানা কাপেটকে কে বিছিয়ে দিয়েছে রাস্তাটার দুধারে।
এই জায়গাটায় বিলের জল খুব গভীর বলে মনে হয় না। কাকচক্ষুর মত পরিষ্কার জল যেন টলটল করছে।
রাস্তাটার দু পাশে বড় বড় বুনো ঘাস গজিয়েছে, আর তার মধ্যে মধ্যে একপ্রকার জলজ কাঁটালতা।
ছোট্ট ছোট্ট লাল ফল সেই কাঁটা লতায় ফুটে আছে। ঘন সবুজের মধ্যে সেই লাল ফুলগুলো যেন রক্তপ্রবালের মত জ্বলছে।
সত্যজিৎ পথ অতিক্রম করে দ্বীপে এসে উঠল। ত্রিভুজাকার দ্বীপটি।
পথটা এসে যেখানে দ্বীপটায় শেষ হয়েছে, সেই মুখেই একটা আমলকী গাছ, ভোরের আলো আমলকী গাছের চিকণ পাতার উপরে বড়ে যেন পিছলিয়ে যাচ্ছে।
একটা দোয়েল আমলকী গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে।
সামনেই ডানহাতে একটা বাঁশঝাড়। বাতাসে বাঁশঝাড়টা আন্দোলিত হয়ে কটকট শব্দ তুলছে।
দ্বীপের মধ্যে পায়ে-চলা একটা পথ ছিল বটে এককালে, তবে এখন বহুদিনের যত্ন ও সংস্কারের অভাবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘন আগাছায় সে পাথর আর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না।
চারিদিকে ঘন সন্নিবেশিত গাছপালা অদ্ভুত একটা আলোছায়ার রহস্য দিয়ে ঘেরা। মধ্যে মধ্যে বায়ুর তাড়নায় বৃক্ষের পত্র ডালপালা আন্দোলিত হয়ে রহস্যময় এক শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করছে।
মনে হয় কারা যেন চাপা গলায় ফিসফিস করে কি বলতে চায়।
অদ্ভুত একটা শিহরণ সর্বাঙ্গে অনুভব করে সত্যজিৎ।
অস্পষ্ট অনুচ্চারিত কার সাবধানবাণী যেন বলছে, এগিয়ো না! এগিয়ে না! ওখানে মৃত্যু! ওখানে বিভীষিকা!
তবু এগিয়ে চলে সত্যজিৎ।
আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে নজরে পড়ে দ্বীপের মধ্যস্থিত বিরাম কুটীর।
কুটীরের ঠিক পশ্চাতেই একটা প্রকাণ্ড বকুল বৃক্ষের তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সত্যজিৎ।
এই সেই বকুল বৃক্ষ।
এরই তলায় উনিশ বছর আগে একদিন নিরুদ্দিষ্টা হেমপ্রভার গলিত মৃতদেহটা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে।
আর দীর্ঘ উনিশ বছর পরে মাত্র সাতদিন আগে এই বকুল বৃক্ষের তলাতেই নায়েব বসন্ত সেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনিও কি বিস্ময়ে নির্বাক হয়েছিলেন?
আশ্চর্য! উনিশ বছরের হলেও এই একই বৃক্ষতলে স্বামী ও স্ত্রীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর নির্মম পরিহাস!
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর শ্বাসরোধ করে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।