মৃত্যুঞ্জয় জমিদার-ভবনে আর ফিরে গেলেন না।
প্রমোদভবনকেই আরো ভাল করে সংস্কার করে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দিলেন।
আর কেউ না জানলেও কানাইয়ের মা জানত, প্রায়ই গভীর রাত্রে জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নন্দনকাননে গিয়ে অন্ধকারে বকুলতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
প্রিয়তমা স্ত্রীকে যেখানকার মাটিতে শেষ শয়ানে শুইয়ে রেখেছিলেন, সেখানকার মাটিই যেন তাঁকে অন্ধকার নিঝুম রাতে হাতছানি দিয়ে ডাকত।
এ খবর আর কেউ জানে না বাবু একমাত্র আমি ছাড়া। বলে চুপ করল কানাইয়ের মা।
সবিতার চোখের কোল দুটো ছলছল করছিল জলে ভরে গিয়ে।
তার মায়ের মৃত্যুর সকরুণ কাহিনী তাকে যেন নির্বাক করে দিয়েছে।
এদিকে রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে খোলা জানলা-পথে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করছিল।
কানাইয়ের মার কণ্ঠনিঃসৃত বেদনাক্লিষ্ট কাহিনী যেন সমগ্র কক্ষটা জুড়ে জমাট বেধে আছে এখনো!
অন্তত বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপা একটা মস্ত বড় রহস্য!
০৬. সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে
সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহও ঐ বকুলতলাতেই পাওয়া গেছে, তাই না?
হ্যাঁ।
এবং মৃতদেহ প্রথমে দেখতে পান বসন্তবাবুই না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমার মার মৃত্যু ও তোমার বাবার মৃত্যু এ দুটো ব্যাপার তোমার কি বলে মনে হয়?
আজ্ঞে দাদাবাবু, আমি তো বলেছিই আমার মনে হয় এ দুটোই কোন অপদেবতার কাজ।
কেন বল তো?
কানাইয়ের মা অতঃপর কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
কি যেন বলতে চায়, অথচ ঠিক বলতে সাহস পাচ্ছে না। সঙ্কোচ বোধ করছে।
বল না কি বলতে চাও? কেন তোমার মনে হয় এ অপদেবতার কাজ?
দেখুন দাদাবাবু, এ বাড়িটাই ভাল না!
বাড়িটা ভাল না?
আজ্ঞে। আমি অনেকদিন টের পেয়েছি এ বাড়িটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অপদেবতা ভর করে আছে।
অপদেবতা ভর করে আছে? কি পাগলের মত যা-তা বকছ কানাইয়ের মা!
হ্যাঁ বাবু, ঠিকই বলছি। নানা রকমের শব্দ রাত্রে অনেক সময় এ বাড়িতে শোনা যায়। অনেক রাত্রে ঘুঙুরের শব্দও শুনেছি।
চকিতে সত্যজিতের প্রথম রাত্রির কথা মনে পড়ে যায়।
সেই মিষ্টি নূপুরের আওয়াজ! সেই নূপুরের আওয়াজকে অনুসরণ করে তার সিঁড়িপথে নিচে নেমে যাওয়া!
সেও তো জাগ্রত অবস্থাতেই সুস্পষ্ট সেই নূপুরের আওয়াজ শুনেছিল!
সে কাউকে দেখতে পায়নি বটে তবে স্পষ্ট কি সে শোনেনি কে যেন নূপুর পায়ে তার ঘরের মধ্যে চলে বেড়াচ্ছিল!
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, মিলিয়ে গেল একটু একটু করে সেই নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ।
তাছাড়া তার ঘরের ওপাশের দরজাটাও তো খোলা দেখতে পেয়েছিল।
তবে কি কানাইয়ের মা যা বলছে তাই ঠিক? সত্যি এ বাড়িতে কোন অপদেবতা আছে?
রাত্রের অন্ধকারে চারিদিক নিঝুম হয়ে এলে, সবাই গাঢ় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলে অশরীরী কেউ এ বাড়ির কক্ষে কক্ষে অলিন্দে প্রাঙ্গণে সিঁড়িপথে নূপুর পায়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়!
কানাইয়ের মা আবার বলে, লোকে বলে আজও নাকি বৌরাণীর প্রেতাত্মা এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি! সে-ই নাকি আজও নিষুতি রাতে ঘুঙুর পায়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়!
বৌরাণী! বৌরাণী আবার কে? কথাটা বলে বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সত্যজিৎ কানাইয়ের মার দিকে।
তাও জাননি! বৌরাণীর নামেই তো এই এত বড় বাড়ি তৈরী হয়েছিল গো। ঐ বিলের জলেই তো বৌরাণী ড়ুবে মরেছিল গো। তাই তো লোকে ঐ বিলকে আজও বলে বৌরাণীর বিল!
এবারে সত্যজিৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সবিতার দিকে।
সবিতাই এবারে অনুচ্চারিত প্রশ্নের যেন জবাব দেয়, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি বটে। তবে আমি কখনো কোন আওয়াজ বা শব্দ নিজের কানে শুনিনি।
আপনার বাবার কাছে কোনদিন কিছু এ সম্পর্কে শুনেছেন মিস চৌধুরী?
না। বাবা আমাকে কখনো কোনদিন আমাদের বংশের কোন কথা বা গল্প বলেননি। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, বাবা যেন ওসব ব্যাপারে অদ্ভুত একটা সংযম রক্ষা করে চলতেন। বহুদিন মনে পড়ে, বাবাকে দেওয়ালে টাঙানো মার এনলার্জড ফটোটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু একটা দিনের জন্যেও বাবা আমার সঙ্গে মার কোন কথাই আলোচনা করেননি। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি কেন তা করেননি।
রাত্রি শেষ হয়ে পূর্ব দিগন্তে প্রথম আলোর রক্তিম ইশারা যেন দেখা দিয়েছে।
খোলা জানলা-পথে সেই রক্তিম আলোর আভাস যেন ওদের অন্তরকে পর্যন্ত এসে স্পর্শ করে গেল।
কানাইয়ের মাকে বিদায় দিয়ে সত্যজিৎ সবিতাকেও যেন একপ্রকার ঠেলেই তার ঘরে পাঠিয়ে দিলে, অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে।
সারাটা রাত্রি জাগরণের পর সত্যজিতের নিজের চোখ দুটোও জ্বালা করছিল। সে ছাদে এসে দাঁড়াল।
চাপা লালচে আলোয় সমস্ত প্রকৃতি যেন সারা রাত্রির অন্ধকারকে অতিক্রম করে রক্তিম চক্ষু মেলে সবে তাকাচ্ছে।
প্রভাতী বায়ুতরঙ্গে বিলের বুকে ক্ষুদ্র ঢেউগুলো ছন্দের আলপনা বুনে চলেছে।
দূরে নজরে পড়ল সেই দ্বীপটা।
দূর থেকে দ্বীপের গাছপালাগুলো তখনও খুব স্পষ্ট মনে হয় না। যেন একটা অস্পষ্টতার কুয়াশায় ঘোমটা টেনে রহস্যে ঘনীভূত হয়ে আছে।
ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদিন রহস্যজনকভাবে সবিতার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল, আবার দীর্ঘ উনিশ বছর বাদে ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদা প্রত্যুষে পাওয়া গেল সবিতার পিতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহ।