সমস্ত বাড়িটার মধ্যে কোথাও এতটুকু কোন শব্দ নেই, এমন কি ছোট মেয়ে সবিতার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত একবারের জন্যে শোনা গেল না।
নিচের তলায় ঠাকুর চাকর দাসীর দল কেবল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
রাত এগারোটার সময় একখানা পাল্কি বেহারারা উপরে নিয়ে গেল এবং আধ ঘণ্টা বাদে কাহার-বাহিত কবাট-বন্ধ করা পাল্কির পিছনে পিছনে ঘুমন্ত সবিতাকে বুকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নেমে এলেন এবং তাঁর পশ্চাতে নেমে এল কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা সবিতাকে নিয়ে অন্য খালি পাল্কিটায় গিয়ে উঠে বসল। ঘোড়ায় জিন দেওয়া ছিল।
নিঃশব্দে রাত্রির অন্ধকারে পাল্কি দুটো প্রমোদভবনের গেট দিয়ে বের হয়ে গেল।
পশ্চাতে ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে পাল্কি দুটোকে অনুসরণ করলেন জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
মাথার উপরে নক্ষত্রখচিত রাতের কালো আকাশ কেমন বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আর বৌরাণীর বিলের ধারে ধারে ঝাউগাছগুলো নিঃশব্দে অন্ধকারে সকরুণ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন সেই বোবা আকাশের গায়ে ছড়িয়ে দিতে লাগল।
চারদিন বাদে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আবার কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এবং এসে উঠলেন আবার প্রমোদভবনেই।
লোকে জানল কলকাতাতেই হেমপ্রভার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ঐ চারদিনের মধ্যেই অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর। তাঁর মাথার অর্ধেকের বেশী চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে, আর তাঁর দুচোখের কোলে পড়েছে গাঢ় কালো একটা রেখা।
সারাটা রাত মৃত্যুঞ্জয় ঘুমাল না।
নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে ভূতের মত প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে ছাতে ও বারান্দার অলিন্দে ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
দিন দুই বাদে কি খেয়াল হতে ভোররাতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নন্দনকাননের দিকে চললেন প্রমোদভবনের খিড়কির দরজাটা খুলে।
বহুদিন মানুষের পায়ের ছাপ এখানে পড়েনি।
জঙ্গলে আকীর্ণ চারিদিক। পা ফেলা যায় না।
হঠাৎ সেই নন্দনকাননের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে প্রকাণ্ড একটা বকুল গাছের তলায় এসে হঠাৎ ভূত দেখার মতই যেন চমকে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঠিক সামনেই বকুল গাছটার তলায় ঘাসের উপরে পড়ে আছে হেমপ্রভার মৃতদেহটা।
ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে দেহটা। এই সাতদিনে পচে দেহটা একটু ফুলেও উঠেছে।
পরিধানে এখনো সেই সাতদিন আগেকার চওড়া লালপাড় শাড়িটা। চিরদিন চওড়া লালপাড় শাড়ি পরতেই হেমপ্রভা ভালবাসতেন।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে মৃত্যুঞ্জয় কতক্ষণ যে ঐখানে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর শবদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মনে নেই।
শোক দুঃখ বেদনা সকল অনুভূতি যেন বুকের মধ্যে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে।
সহসা একটা খসখস শব্দে চমকে ফিরে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়। ঠিক পশ্চাতে হাত-চারেকের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা তুই এখানে? কঠিন একটা উষ্মার ভাব মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ে।
কানাইয়ের মা কোন জবাব দিতে পারে না।
নিঃশব্দে মাথা নিচু করে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে থাকে।
কানাইয়ের মাও হেমপ্রভার মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিল।
সত্যই কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত।
হেমপ্রভাই তাঁর বাপের বাড়ি থেকে অল্পবয়সী বিধবা সদ্যপুত্রহারা কানাইয়ের মাকে খাস দাসী করে নিয়ে এসেছিলেন।
কলকাতা থেকে ফিরে রাত্রে যখন অত বড় বাড়িটার মধ্যে নিঃশব্দে একা একা ছায়ার মত মৃত্যুঞ্জয় ঘুরে বেড়াতেন, অলক্ষ্যে থেকে সদাসতর্ক দৃষ্টি দিয়ে কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উপরে নজর রাখছিল। মৃত্যুঞ্জয় যে তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভাকে কত গভীরভাবে ভালবাসতেন কানাইয়ের মা তা জানত। এবং সেই কারণেই হেমপ্রভার এই আকস্মিকভাবে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা মৃত্যুঞ্জয়ের মনের মধ্যে যে কত নিদারুণ আঘাত হেনেছে তাও সে বুঝেছিল।
স্ত্রীর শোকে মনের ঝোঁকে মৃত্যুঞ্জয় হঠাৎ আত্মহত্যা বা ঐ ধরনের কিছু করে ফেলেন এই ভয়েই কানাইয়ের মা সদা-সতর্ক দৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয়কে দিবারাত্র
অলক্ষ্যে থেকে ছায়ার মত অনুসরণ করছিল।
এবং ঐভাবে অনুসরণ করতে করতে ভোররাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিছু পিছু নন্দনকাননে এসেছিল সে।
হেমপ্রভার মৃতদেহ ঐভাবে নন্দনকাননের বকুলতলায় দেখে সেও কম বিস্মিত হয়নি।
বল, কেন তুই এখানে এসেছিস?
আবার রুক্ষকঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
কানাইয়ের মা তখন অকপটে প্রভুর কাছে সব কথা খুলে বললে।
মৃত্যুঞ্জয় এর পর আর কিছু বলতে পারলেন না কানাইয়ের মকে। কানাইয়ের মা যে তাঁর প্রতি গভীর মমতাবশেই ঐখানে ঐভাবে তাঁকে অনুসরণ করে এসেছে জানতে পেরে কেন যেন তাঁর অন্তরটা স্নিগ্ধ হয়ে এল।
ঐদিনই গভীর রাত্রে নিজ হাতে বকুলতলাতেই মাটি খুড়ে কানাইয়ের মার সাহায্যে মৃতা স্ত্রীর শেষকৃত্যটকু পালন করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মা ভিন্ন আর দ্বিতীয় কোন প্রাণীই ঐ ব্যাপারটা জানতে পারল না।
এবং সেই দিন থেকেই মৃত্যুঞ্জয় সবিতার সমস্ত ভার কানাইয়ের মার হাতেই তুলে দিলেন।
আর কানাইয়ের মাকে বিশেষ করে সাবধান করে দিলেন লোকে যেমন জেনেছে যে হেমপ্রভার কলকাতাতেই রোগের মৃত্যু হয়েছে তাই যেন জানে, এর বেশী কেউ যেন কিছু না জানতে পারে।