প্রমোদভবনের তিন দিক ঘিরে দেড়মানুষ সমান উঁচু, প্রাচীর।
বায়ুর তাড়নায় বিলের জল প্রাচীরের গায়ে ছলছলাৎ করে আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
প্রমোদভবনের পশ্চাতের দ্বার খুললেই চোখে পড়ে প্রায় শদুই গজ দূরে একটা ছোট দ্বীপের মত। প্রমোদভবন থেকে সেই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সেগুন, শালকাঠ ও পাথর বিলের জলের মধ্যে ফেলে একটা রাস্তা তৈরী করা হয়েছে।
রাস্তাটা অপ্রশস্ত—তিনজনের বেশী লোক একত্রে পাশাপাশি হাঁটতে পারে না।
দ্বীপটা ত্রিভুজাকার। দ্বীপের মধ্যে ছোট বড় নানাজাতীয় বৃক্ষ যেন একটা অরণ্যস্ততা এনেছে। দ্বীপের ঠিক মধ্যস্থলে একটি চমৎকার পাথরের তৈরী একতলা ছোট বাড়ি। বাড়ির মধ্যে খানতিনেক ঘর মাঝারি আকারের। বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে দেশী-বিদেশী নানাজাতীয় ফলের গাছ।
বহুদিনের অযত্ন-বর্ধিত হয়ে এখন সম্পূর্ণ বাগানটি একটা যেন ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
আপন মনেই এখন ফুল ফোটে, ফল ঝরে, আগাছা বেড়ে চলে।
দীর্ঘকালের অযত্নে বাড়িটার ঘরের জানালা-কবাটগুলো জীর্ণ ও ধংসপ্রায়।
দিবারাত্র বাতাসে মচমচ, খটখট শব্দ করে।
জমিদার বাটি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ছিল এক দিগন্তপ্রসারী বিল। এই বিলের যোগাযোগ ছিল একেবারে পদ্মার সঙ্গে।
চারপুরুষ আগে করালীপ্রসন্ন চৌধুরী তাঁর প্রিয়তমা মহিষী রাণী কাঞ্চনমালার জন্যে ঐ বিলের মধ্যে পাথর ফেলে এক প্রমোদভবন গড়ে তোলেন। এবং বিলের মধ্যেই পাথর ফেলে মাটি ঢেলে তৈরী করেন এক নকল দ্বীপ। ফুলফলের গাছগাছড়া লাগিয়ে দ্বীপের প্রাণসঞ্চার করেন।
নির্মাণ করেন দ্বীপের মধ্যস্থলে একটি সুরম্য ছোট বিশ্রামভবন। তার চারপাশে দিগদেশ হতে নানাবিধ, আকার, গন্ধ ও বর্ণ-বৈচিত্র্যের ফুলের গাছ এনে রচনা করেন এক উদ্যান; তারই নাম দেন নন্দনকানন।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যখন তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভাকে নিয়ে প্রমোদভবনে এলেন, বহুদিনের অবহেলায় ও অব্যবহার্যে এবং কালের নিষ্ঠুর আঘাতে আঘাতে প্রমোদভবন জীর্ণ ভগ্নপ্রায় এবং দ্বীপের মধ্যে নন্দনকানন জঙ্গলাকীর্ণ ও ভীষণ কালনাগের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে।
প্রমোদভবনকে যথাসাধ্য মেরামত ও সংস্কার করে নিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
অল্পদিনের মধ্যেই হেমপ্রভার স্বাস্থ্যেরও উন্নতি দেখা গেল। কিন্তু নিষ্ঠুর ভবিতব্য যা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর জন্যে অলক্ষ্যে অপেক্ষা করছিল, জীবনের সুধার পূর্ণ পাত্রটিকে সহসা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
দাসী কানাইয়ের মা ও সবিতাকে নিয়ে রুগ্না হেমপ্রভা একটি কক্ষে শুতেন। পাশের ঘরেই শয়ন করতেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মার নিদ্রারোগটা চিরদিনই বেশী। একদিন সকালে কানাইয়ের মার ডাকাডাকি ও চেঁচামেচিতে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘুম ভেঙে জানলেন হেমপ্রভাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হন্তদন্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন, শয্যার উপরে তখনও চার বছরের শিশুকন্যা সবিতা অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।
মাকে যে তার পাওয়া যাচ্ছে না, কিছুই তার সে জানে না। বাড়ির অন্যান্য ভৃত্যরা—তখনও সকলে ঘুম ভেঙে ওঠেনি।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যেন পাগলের মত হয়ে গেলেন।
কোথায় গেল হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে! তাঁদের দীর্ঘ দশ বৎসরের বিবাহিত জীবনের প্রতিটি দিনরাত্রির ইতিহাসকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী হেমপ্রভার আকস্মিক অন্তধানের কোন কারণ বা মীমাংসা খুঁজে পেলেন না।
কোনদিনের জন্যও তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতটকু ভুল বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্যের কারণ ঘটেনি যাতে করে সহসা এমনিভাবে হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে গৃহত্যাগ (?) করতে পারে।
হেমপ্রভাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, একমাত্র কানাইয়ের মা ও তিনি নিজে ছাড়া তৃতীয় আর কেউ জানে না।
কানাইয়ের মাকে নিজের ঘরে ডেকে এনে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘরের দরজায় খিল তুলে দিলেন।
শোন কানাইয়ের মা, তোর মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না একথা যেন কেউ জানতে পারে। একমাত্র তুই ও আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ জানে না। ঘুর্ণাক্ষরেও একথা কেউ কোনদিন যদি জানতে পারে তবে তোকে জ্যান্ত নন্দনকাননে মাটির তলায় কবর দেব।
কানাইয়ের মা থরথর করে কাঁপছিল। গলাটা তার শুকিয়ে গিয়েছে, কোনমতে একটা ঢোক গিলে শুষ্ক নিম্নকণ্ঠে বললে, মরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না বাবু
মনে থাকে যেন। হ্যাঁ দেখ, আজই রাতে আমি সবিতাকে নিয়ে কাশী যাব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি। নিচের ঠাকুর চাকর কেউ যেন ওপরে না আসে। বলবি তোর মার কাল রাত থেকে অসুখের খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে। যা–
বাড়ির সকলেই জানল গত রাত থেকে হেমপ্রভা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন খুব খারাপ অবস্থা চলছে। আজ রাত্রেই জমিদারবাবু অসুস্থা স্ত্রী, কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাচ্ছেন।
স্ত্রীর অসুখের সংবাদ দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী রাত এগারোটায় স্টেশনে যাবার জন্যে দুখানা পাল্কির ব্যবস্থা করতে বললেন নায়েবকে। রাত দুটোর গাড়িতে তিনি সস্ত্রীক কলকাতায় যাবেন।
নায়েব বসন্ত সেনকে আদেশ দিয়েই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আবার দোতলায় চলে গেলেন।
সমস্ত দিন বাড়িটা অসহ্য নিস্তবতায় থমথম করতে লাগল। যেন একটা ভয়াবহ সতর্কবাণী বাড়ির লোকজনদের বিভীষিকার মত ঘিরে রইল।