কানাইয়ের মা অনেক কথা জানে। হয়ত সেসব কথা জানতে পারলে বর্তমান রহস্যের উপরে অনেকখানি আলোকসম্পাত হবে।
সব গুছিয়ে কৌশলে কানাইয়ের মার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
কানাইয়ের মার কয়েকটি কথাতেই সত্যজিৎ বুঝেছিল, মেয়েমানুষ হয়েও এতকাল একমাত্র জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ভয়েই হয়ত কানাইয়ের মা যেসব গোপন কথা এতকাল কারো কাছে মন খোলসা করে বলতে সাহস পায়নি, অথচ ভিতরে ভিতরে যে কথাগুলো তার স্বাভাবিক নারীমনের বৃত্তিতে কারো কাছে উগরে দেবার জন্য ছটফট করেছে—সত্যজিতের কাছে তারই কিছু হয়ত হঠাৎ বলে ফেলেছে।
সত্যজিতের ধারণা যে মিথ্যে নয় সেটা সে পরমুহূর্তে বুঝতে পারে কানাইয়ের মায়ের পরবর্তী কথায়, অনেক কথা বলে ফেননু বাবু। কাউকে আবার যেন বলোনি। কত্তাবাবু, আজ আর বেঁচে নেই বটে তবে ধর্মের ভয় তো আছে গো।
তা তো নিশ্চয়ই। তোমার কোন ভয় নেই কানাইয়ের মা। আমি সব শুনেছি, তুমি এদের কত বড় আপনার লোক। দিদিমণির তুমি মায়ের সমান। দিদিমণিই বলছিল তুমি তো তার মায়ের মতই
তা বইকি বাবু! আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে কানাইয়ের মা। হাজার হলেও নারীর মন তো। সত্যজিতের কথাগুলো তার নারীচিত্তের ঠিক জায়গাটিতেই গিয়ে ঘা দিয়েছে।
আমিও তো তাই বলি কানাইয়ের মা। পেটে ধরলেই কি কেবল মা হয়! দেখো তোমরা যাই বল, অপঘাতে বাবুর মৃত্যু হয়েছে, আমার কিন্তু ধারণা এ কোন দুষ্ট লোকের কাজ—
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা, সত্যজিতের মুখের দিকে।
হ্যাঁ। সব তোমাকে আমি বলব কিন্তু তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার কতকগুলো কথা জানা দরকার।
আমি কি জানি বাবু
আজ রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর একবার আসতে পার কানাইয়ের মা এ ঘরে? আমি আর তোমার দিদিমণি থাকব। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
তা আর পারবোনি কেন, আসবোখন।
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা; কুণ্ঠে গেলি
মুখপোড়া বনমালী মিনষে আবার চেঁচাতে নেগেছে, যাই বাবু
বলি অ কানাইয়ের মা, কানের মাথাটি খেয়ে বসে আছিস নাকি! রা-টি কাড়ছিসনি কেন রে বুড়ী
বলতে বলতে ঘরের মধ্যে বনমালীর আবির্ভাব, এই যে তু ইখানটিতে বসে। ঠাকুর যে উদিকে চেচায়ে মরছে। রান্নাবান্না হবে, না হবেকনি—
যাচ্ছি, যাচ্ছি—চল।
কানাইয়ের মা বনমালীকে সঙ্গে করে নিয়েই ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সবিতা এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল, সত্যজিৎবাবু
আসুন সবিতা দেবী।
কানাইয়ের মা বুঝি বকরবকর করে আপনাকে বিরক্ত করছিল?
সত্যজিৎ সবিতার কথায় মৃদু হাসল, না, বরং আমিই তাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিলাম।
অমন কাজটিও করবেন না। একবার বকতে শুরু করলে ও আর থামতে চায় না।
বসুন মিস চৌধুরী।
সবিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সত্যজিতের মুখোমুখি উপবেশন করল।
আপনি হয়ত জানেন না মিস চৌধুরী, অনেক সময় অবান্তর বাজে কথার মধ্যে থেকেই কাজের ও প্রয়োজনীয় কথা খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু ওর যে ষোল আনার মধ্যে সাড়ে পনের আনা কথাই অবান্তর!
তা হোক, বুড়ী লোকটি ভাল।
কি করে বুঝলেন?
শুনন মিস চৌধুরী, ওকে আজ রাত্রে এ ঘরে আসতে বলেছি। আরো বলেছি, আমি ও আপনি এ ঘরে থাকব।
কেন বলুন তো?
আচ্ছা আপনি আপনার মায়ের মৃত্যু-ব্যাপার সম্পর্কে কিছু জানেন?
বিস্ময়ের সঙ্গে সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে তাকায়, কেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন হঠাৎ? কানাইয়ের মা কিছু সে সম্পর্কে বলছিল নাকি?
না, কিছু বলেনি বটে তবে আমার মনে হয় কানাইয়ের মা হয়ত কিছু জানে।
সবিতা প্রথমটায় একটু ইতস্তত করে, তারপর বলে, হ্যাঁ। আমিও একবার ছোটবেলায় কানাঘুষোয় মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে কি একটা রহস্য জড়িয়ে আছে শুনেছিলাম বটে, তবে details কিছুই জানি না। কিন্তু কানাইয়ের মা সে কথা জানবে কি করে
সত্যজিৎ তখন একটু পূর্বে কানাইয়ের মার সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সব বিশদভাবে খুলে বললে।
সবিতা নিঃশব্দে সব শুনে গেল।
তাই আমি ঠিক করেছি, যতটা পারি প্রশ্ন করে ওর কাছ থেকে আমাদের জেনে নিতে হবে। আরো একটা কথা, আপনার মাও নাকি এই বাড়িতেই মারা যান!
কই, সে কথা তো আমি শুনিনি?
শুনলেও হয়ত আপনার মনে নেই। একেবারে ছোট্টটিই তো ছিলেন আপনি তখন।
আপনার কি মনে হয় সত্যজিৎবাবু, এ রহস্যের আপনি মীমাংসা করতে পারবেন?
আমার কি ধারণা জানেন মিস চৌধুরী? মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। মানুষই যদি হত্যা করে থাকে তাঁকে তবে মানুষই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারে। মানুষই problem তৈরী করে, আবার মানুষই সেটা solve করে।
দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে কানাইয়ের মা যে কথাগুলো একমাত্র চৌধুরী মশায়ের ভয়ে বুকের মধ্যে জমা রেখে দিয়েছিল, সেগুলো সত্যজিৎ ও সবিতার কাছে বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দীর্ঘ উনিশ বছর আগেকার কাহিনী।
সবিতার মা হেমজার শরীরটা কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না।
তাই স্ত্রী হেমপ্রভা, ছোট চার বছরের মেয়ে সবিতা ও কানাইয়ের মাকে নিয়ে প্রমোদভবনে এক মাসের জন্যে বিশ্রাম নিতে এলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
চারদিকে খোলা-মেলা বিলের হাওয়া, নির্জনতা স্ত্রীর মন ও শরীরের উপরে একটা পরিবর্তন ঘটাবে এইটাই ভেবেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
শহর থেকে দূরে নির্জন এই বিলের ধারে যেন অবারিত মুক্তির একটা কোমল স্পর্শ।