কেন বলুন তো?
কারণ আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে যাবতীয় সকলের জবানবন্দি নিয়ে এটা অন্ততঃ বুঝতে পেরেছি, হত্যাকারী এখানকার কেউ নয়।
আপনি তাহলে বলতে চান বাইরের কেউ প্রশ্ন করে সত্যজিৎ।
নিশ্চয়ই।
কিন্তু উদ্দেশ্য?
তা উদ্দেশ্যও একটা আছে বৈকি। গম্ভীর স্বরে প্রত্যুত্তর দেন লক্ষীকান্তবাবু।
আপনি ধরতে পেরেছেন নাকি কিছু?
সেটা অবশ্য ভেবে দেখতে হবে।
বিশ বছরের অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে লক্ষ্মীকান্তর অকাট্য যুক্তির বহুর শুনে সত্যজিৎ মনে মনে কৌতুক অনুভব না করে পারে না। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সকৌতুকে চেয়ে থাকে লক্ষীকান্তর মুখের দিকে।
অতঃপর লক্ষ্মীকান্ত সবিতাকে জিজ্ঞাস্য প্রশ্নগুলি করতে লাগলেন।
আচ্ছা সবিতা দেবী, আপনি বলতে পারেন, আপনার পিতার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন কেউ আছে কিনা যার সঙ্গে আপনার বাবার শত্রুতা ছিল?
না।
কেন বলুন তো
কারণ বাবার পিতৃবংশের দিক থেকে তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল বলে জানি না। বাবা ঠাকুর্দার একমাত্র ছেলে।
আপনার পিতার একটি ভগ্নী ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা—
পিসিমা আমার জন্মের পূর্বেই মারা যান শুনেছি। তাঁর একমাত্র পুত্র শুনেছি বর্মা না মালয় কোথায় ডাক্তারী করেন। তাঁকে জীবনে দেখিওনি কখনো, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হবারও কোন সৌভাগ্য হয়নি। আর বাবার মাতৃবংশে শুনেছি বাবার দুই মামা বাবার চাইতে বয়সে ছোট, এখনও বেঁচে আছেন, বিক্রমপুরের ওদিকে কোথায় জমিদার। তাঁদের সঙ্গেও আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
হুঁ। আচ্ছা দেখুন, জমিদারী ও ব্যবসা চালাতে গেলে বহু, লোকের সঙ্গে শত্রুতা ইচ্ছা না থাকলেও হয়ে যায় জানি তো—এখন ব্যক্তিবিশেষের কথা
না, সেরকম শত্রুও বাবার কেউ কোন দিন ছিল বলে জানি না।
ভাল করে ভেবে বলুন সবিতা দেবী, এমনও হতে পারে আপনি জানেন না!
আমার বাবাকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম।
কিন্তু আমি তো শুনেছি আপনি আপনার সাত বছর বয়স থেকেই বিদেশে। কেবল মধ্যে মধ্যে ছুটিতে যা এখানে আসতেন।
তাহলেও আমি তাঁকে খুব ভাল করেই জানতাম।
ও! তাহলে এবারে আমি উঠব।
আসুন।
লক্ষ্মীকান্ত বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
০৫. শ্মশান হতে ফিরে
শ্মশান হতে ফিরে সবিতা স্নান সেরে তার নিজের ঘরে শয্যার উপরে গা এলিয়ে পড়েছিল। সমস্ত শরীরে একটা ক্লান্ত অবসন্নতা।
কানাইয়ের মা এক গ্লাস সরবৎ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
দিদিমণি, এই সরবটুকু খেয়ে নাও দেখি—
ওই টেবিলের উপর রেখে যা কানাইয়ের মা।
না। এই সরবটুকু তুমি খেয়ে নাও।
বিরক্ত করিস না। যা বলছি তাই শোন। সত্যজিৎবাবুকে চা-জলখাবার দিয়েছিস?
হ্যাঁ, তৈরী হয়ে গেছে, এবার দেব।
তোদের দিয়ে কোন কাজ হয় না। আগে কোথায় তাঁকে চা-জলখাবার। দিবি, তা নয় আমার জন্য সরবৎ নিয়ে এসেছিস!
লজ্জিত কানাইয়ের মা সরবতের গ্লাসটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে সত্যজিৎকে চা-জলখাবার দেবার জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সত্যজিৎ তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসেছিল।
বনমালী ঘরের মধ্যে সেজ বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে বটে তবে আলোর শিখাটা কমানো।
খাবারের প্লেট ও চায়ের কাপ হাতে কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল, বাবু!
কে?
চা এনেছি বাবু।
তোমার দিদিমণিকে কিছু খেতে দিয়েছিলে কানাইয়ের মা?
হ্যাঁ, সরবৎ দিয়ে এসেছি।
খাবারের প্লেটটা ও চায়ের কাপ পাশের একটা চৌকির উপরে নামিয়ে রেখে কানাইয়ের মা ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য উদ্যত হল।
সত্যজিৎ ডাকল, কানাইয়ের মা!
সত্যজিতের ডাকে কানাইয়ের মা ফিরে দাঁড়াল।
ওইখানে এসে বসো কানাইয়ের মা। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সত্যজিতের আহবানে কানাইয়ের মা তার সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
ওইখানে বসো।
কানাইয়ের মা মাটিতেই বসল।
চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললে, তুমি তো এ বাড়িতে অনেক দিন আছ শুনলাম, পুরনো লোক—
দিদিমণির এককুড়ি তিন বছর বয়স হল। তা ধর না গো—তারও দুবছর আগে থেকে এ বাড়িতে আমি আছি বাবু। পুরনো নোক বইকি।
অর দিদিমণিও তো শুনেছি তোমারই কোলেপিঠে মানুষ।
তা ছাড়া আর কার? আমারই কোলেপিঠে দিদিমণি মানুষ হল তো!
আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমাদের দিদিমণির বাবা মানে কর্তাবাবু, তুমি তো জান তাকে কেউ খুন করেছে—
আহা! আর বোলোনি গো বাবু, মেয়েটার কি দুঃখের কপাল! ওর মা আহা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-ঠাকরুণ ছিলেন গো—স্বগগের দেবী, মেয়েটার চার বছর বয়সের সময় অঘোরে মারা গেল এই হতচ্ছাড়া বাড়িতেই। কত্তাবাবুও এই বাড়িতেই মারা গেল অঘোরে। এই বাড়িটাই অলুক্ষুণে বাবু
তোমার দিদিমণির মাও এই বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন নাকি?
তাছাড়া আর কি! এই বাড়িতেই তো!
কি হয়ে মারা যান তিনি?
কাউকে বোলোনি বাবু। কেউ জানে না। কত্তাবাবুর মানা ছিল, এতদিন কাউকে বলিনি
তোমার দিদিমণিও জানে না?
না। এক কত্তাবাবু জানতেন—আর জানতাম আমি
সত্যজিৎ কৌতূহলে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সবিতার মার মৃত্যুর মধ্যেও তাহলে একটা রহস্য রয়ে গিয়েছে। কেবল জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরই রহস্যময় মৃত্যু ঘটেনি, উনিশ বছর আগে সবিতার মার মৃত্যুর ব্যাপারেও এমনি কোন রহস্য ছিল। এবং শুধু তাই নয়, উভয়েরই মৃত্যু একই বাড়িতে ঘটেছে।