বসবার ভঙ্গিটা যেন কেমন শিথিল অসহায় বলে মনে হয়।
বুঝতে পারছিলাম, রাধেশ রায় আজ রাত্রে বিশেষ কিছু বলবার জন্যই এভাবে আমায় ডেকে এনেছেন। কিন্তু যে কারণেই হোক সংকোচ বোধ করছেন। চেষ্টা করেও যেন সংকোচ বা দ্বিধাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। আমিও তাঁকে সময় দিতে লাগলাম। যা বলবার উনি নিজে থেকেই বলুন। সংকোচ ওঁর কেটে যাক। বলতেই যখন চান। ওদিকে তাঁর গ্লাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, আবার গ্লাস ভর্তি করে নিলেন।
দ্বিতীয় গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে এবারে আমার দিকে তাকালেন, তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, রহস্যভেদী, আপনার তীক্ষ্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুভূতির উপরে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। বুঝতে পারছি না ঠিক তবে মনে হচ্ছে something somewhere wrong! To tell you frankly, I want your help!
কি ব্যাপার? মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
You know my son অশোক! Recently I dont know why but I feel much worried about him!
একটু বেশ আশ্চর্য হয়েই রাধেশ রায়ের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর একটু থেমে মৃদুকণ্ঠে বললাম, কি ব্যাপার বলুন তো? আমি তো যতদূর শুনেছি আজকাল অশোকবাবু বেশ promising in the Bar—কতকটা যেন আশা দেবারই চেষ্টা করি।
হ্যাঁ হ্যাঁ—তা জানি। কিন্তু সব কথা বলবার আগে একটা কথা আপনাকে আমি বলতে চাই মিঃ রায় বিশেষ করে শেষের দিকে একটু যেন থেমেই কথাগুলো বললেন ব্যারিস্টার।
বলুন? ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করি।
সব কথা বলবার আগে যে কথা বিশেষ করে বলতে চাই মিঃ রায়, অশোক যেন এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু না জানতে পারে। আশা করি বুঝতেই পারছেন, সে আমার একমাত্র ছেলে। মা নেই, বড় অভিমানী।
সংকোচটা যেন ব্যারিস্টার সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
নিশ্চিন্ত থাকুন। আশ্বাস দিই ব্যারিস্টারকে।
অবশ্য সেটা আমি জানি বলে আপনাকেই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য ডেকে এনেছি মিঃ রায়।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
কেবল ব্যারিস্টার সাহেব মধ্যে মধ্যে পেগ-গ্লাসটা তুলে চুমুক দিতে লাগলেন নিঃশব্দে। মুখ দেখে বোঝা যায় অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি কি ভাবছেন। মনে মনে নিজেকেই নিজে যেন যাচাই করে চলেছেন।
অশোক কয়েক মাস ধরে দেখছি যেন একটু বেশি খরচ করছে! হঠাৎ আবার ব্যারিস্টার সাহেব কথা বললেন।
তা অল্প বয়েস; বিয়ে-থা করেননি, যথেষ্ট ইনকাম করেন, কোনো liabilities-ও নেই—তাছাড়া এই তো খরচ করবার সময়। হাসতে হাসতে জবাব দিই।
বাধা দিলেন ব্যারিস্টার, না না—ঠিক তা নয় মিঃ রায়। যতই খরচ করুক সে, তিন-চার হাজার টাকা একজনের মাসে pocket expense—একটু কি বেশিই বলে মনে হয় না আপনার?
তিন-চার হাজার! এবারে সত্যি বিস্ময়ের পালা আমার।
হ্যাঁ। না হলে আর বলছি কি? আমার আর অশোকের অ্যাকাউন্ট অবশ্য আলাদা। জীবনে স্বাবলম্বনের চিরদিন আমি বিশেষ পক্ষপাতী তাই তার নামে বিলেত থেকে সে ফিরবার পরই হাজার পঞ্চাশ টাকা দিয়ে starting একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। তার কাছ থেকে কোনদিনই কোন কিছু আমি আশা ও করি না এবং তার রোজগার ও খরচ সম্পর্কেও কোনদিন খোঁজ-খবর নেবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কিন্তু মাত্র দিন আষ্টেক আগে হঠাৎ ভুল করে, just by mistake, তার ব্যাঙ্কের একখানা চিঠি আমি খুলতেই ব্যাপারটা আমার নজরে পড়ল।
কি রকম?
তাই তো বলছি।
আমি আবার ব্যারিস্টার সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম।
রাধেশ রায় আবার বলতে শুরু করলেন যেন একটু থেমেই, একসঙ্গে গত তিন মাসের statement of account এসেছে
অশোকই মনে হয় চেয়ে পাঠিয়েছিল ব্যাংকে। এবং just out of curiosity সেই statement of account-টা দেখতে গিয়েই নজরে পড়ে গেল আমার প্রত্যেক মাসে সে প্রায় তিন-চার হাজার করে টাকা ড্র করেছে। এবং গত প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে একটা করে আড়াই হাজার টাকার self-draw আছে। আমি তো চমকে গেলাম। প্রত্যেক মাসে তার এত অর্থের কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আর প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে ঐ আড়াই হাজার টাকাই বা draw করা হচ্ছে কেন? ব্যারিস্টার বলতে বলতে থামলেন বোধ হয়। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার জন্যই।
কোনো heavy insure বা payment-ও তো থাকতে পারে। বললাম আমি।
Nothing of that kind! ওর কোন insure-ই নেই। যা হোক—কেমন মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিঃ ওয়াটসন আমার বিশেষ বন্ধু ও অনেক দিনের পরিচিত। Irang him up। সে যা বললে, তাতে বিস্ময় যেন আরও বাড়ল। সে বললে, গত এক বৎসর ধরেই নাকি অশোক প্রতি মাসের দশ তারিখে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঐ আড়াই হাজার টাকা self-cash করে নিয়ে আসে।
হুঁ।
বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কি রকম delicate! যা হোক আমি দুটো দিন ব্যাপারটা নিজে নিজেই ভাববার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো conclusion-এই পৌঁছতে পারলাম না। যতই আমার সন্দেহ বাড়তে লাগল, সেই সঙ্গে ঔৎসুক্যও বাড়তে লাগল। যদিও ব্যাপারটা বিশ্রী, তবু তলে তলে গোপনে আমি তার উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না রেখে থাকতে পারিনি।
ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর বক্তব্য শেষ করে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, মিঃ রায়, বুঝতে পারলেন কিছু?