তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায় ঐ বৈকালী সঙ্ঘের একজন নিয়মিত সত্য। কোর্ট হতে ফিরে সন্ধ্যার পর নিজের গাড়ি নিয়ে সে বের হয়ে যায়, ফেরে কোন রাতেই সাড়ে এগারোটার আগে নয়। অশোক রায় সম্পর্কে খোঁজ করতে করতেই সব জানা গিয়েছে।
অশোক রায় ঘটিত ব্যাপারটা অবশ্য কিরীটীর মুখেই আমার শোনা এবং বলাই বাহুল্য বিচিত্রও। বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের সঙ্গে বছর চারেক আগে কিরীটীর একটা জাল দলিলের মামলার ব্যাপারে আলাপ-পরিচয় হয় এবং ক্রমে সেই আলাপ-পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। পূর্বেই বলেছি ঘটনার আদিপর্বটা কিরীটীর মুখ থেকেই শোনা, তাই কিরীটীর জবানিতেই বলছি:
সন্ধ্যার দিকে একদিন রাধেশ রায় আমাকে ফেন করলেন: রহস্যভেদী, কাল সন্ধ্যার পর এই ধরুণ গোটা আট-নয়ের সবয় আপনি ফ্রি আছেন কি?
কেন বলুন তো? আসুন না। অনেককাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে আর গল্পসল্পও করা যাবে।
ব্যারিস্টার রাধেশ রায় যে কি ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তাঁর চেম্বারে মক্কেলের ভিড় থাকে আর রাত্রেও বারোটা-একটা পর্যন্ত লাইব্রেরি ঘরে বসে তিনি নিয়মিত পড়াশুনা করেন।
তাই হাসতে হাসতে বললুম, ব্যাপার কি বলুন তো? ভূতের মুখে রাম-নাম!
না, না, আসুন না—সত্যিই just a social call! ফোনেই বললেন রাধেশ রায়। কিন্তু বিশ্বাস হল না সম্পূর্ণরূপে ব্যারিস্টারের কথাটা।
যা হোক পরের দিন ঠিক রাত নটায় বালিগঞ্জ প্লেসে রাধেশ রায়ের বিরাট ভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম।
চেম্বারে প্রবেশ করে দেখি সব চেয়ার খালি, আশ্চ! কেবল আবেশ রায়ের পাসোন্যাল টাইপিস্ট হিমাংশু একা আপন মনে বসে খটখট করে কি সব টাইপ করে চলেছে মেশিনে।
হিমাংশুঁকেই প্রশ্ন করলাম; ব্যারিস্টার সাহেব কোথায়?
হিমাংশু টাইপ করা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনিই কি মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
বসুন—পরক্ষণে সে ভিতরে গিয়ে কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে একজন উর্দিপরা বেহারা এসে দাঁড়াল।
হিমাংশু তাকে আমার আসবার সংবাদ সাহেবকে দিতে বলল।
মিনিট পাঁচেক বাদে ব্যারিস্টার সাহেবের খাস ভৃত্য কানু এসে বললে, সাহেব আপনাকে উপরে যেতে বললেন, চলুন।
চল।
কানুকে অনুসরণ করে পুরু কার্পেট মোড়া সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় টানা বারান্দার শেষ ও দক্ষিণ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিপূর্বেও বাড়িতে গেলে ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসেই গল্পসল্প হত। উপরে উঠলাম এই প্রথম।
দরজার পর্দা তুলে কানু আহ্বান জানাল, আসুন।
ব্যারিস্টার সাহেবের শয়নকক্ষ। মেঝেতে পুরু নরম কার্পেট এবং ঘরে বহু মূল্যবান সব আসবাবপত্র, রুচি ও আভিজাত্যের চমৎকার সমম্বয় সর্বত্র।
ঘরের সংলগ্ন একটি চারিদিকে খোলা ছাদের মত জায়গা। মাথার উপরে অবশ্য খানিকটা আচ্ছাদন আছে। চারিদিকে ফুলের, পাতাবাহারের ও পামট্রির টব বসান। ছোটখাটো একটা নাশারী বললেও চলে।
একধারে একটি সুদৃশ্য গোল টেবিল, তার পাশে দুটি গদি-আঁটা চেয়ার। এখামা মাত্র খালি এবং অন্য একটিতে বসে আছেন ব্যারিস্টার সাহেব স্বয়ং।
টেবিলের উপরে সাদা দুধের মত ডোমে ঢাকা একটি বৈদ্যুতিক টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। মধ্যিখানে একটি ২৩ অংশ পূর্ণ ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট স্কচ হুইস্কির কালো রঙের বোতল, সোডা সাইফন, একটি খালি পেগ গ্লাস ও পূর্ণ একটি পেগ গ্লাস।
পদশব্দে ব্যারিস্টার মুখ তুলে তাকালেন, আসুন রহস্যভেদী, বসুন।
তারপরেই কানুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, কানু, বাইরের দরজায় বসে থাক। যতক্ষণ না ডাকি তোকে, এদিকে আসবার দরকার নেই।
আচ্ছা। কানু জবাব দেয়।
হ্যাঁ, কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে ফোন এলে হিমাংশুই ধরবে—সে আমার লাইব্রেরি ঘরে আছে।
কানু চলে গেল।
মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে ব্যারিস্টার সাহেবের দিকে তাকালাম।
পরিধানে সাদা ফ্লানেলের পায়জামা ও ডিপ কালো রঙের কিমনো।
শোনা যায় প্রথম যৌবনে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন নাকি রাধেশ রায়। এখনও অবশ্যি বয়স হলেও সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। উজ্জ্বল গৌর গাত্র-বর্ণ। প্রশস্ত কপাল। মাথার দুপাশে একটু টাক পড়েছে। রগের দু-একটা চুলে পাক ধরেছে। খড়ের মত উন্নত নাসা। দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ। কঠিন ধারালো চিবুক।
মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো, চোখেসোনার ফ্রেমে প্যাঁসনে।
আমাকে কিছু না বললেও তাঁর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকতেই বুঝতে কষ্ট হল না সমগ্র সেই মুখখানা ব্যেপে পড়েছে যেন কিসের একটা চিন্তার সুস্পষ্ট ছায়া।
Have a peg-রাধেশ রায় বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে।
দিন তবে ছোট একটা, জবাব দিলাম।
রাধেশ রায় নিজেই শূন্য পেগ গ্লাসটিতে লিকার ঢেলে সোডা সাইফনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
সোডা আমিই মিশিয়ে নিলাম।
Best of luck!
পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে দুজনেই আমরা গ্লাসে চুমুক দিলাম। মিনিট পাঁচ-সাত তারপর নিঃশব্দেই কেটে গেল।
মাঘের মাঝামাঝি হলেও শীতের তীব্রতা তেমন অনুভূত হয় না। ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মিশে আছে বায়ুতরঙ্গে মিষ্টি ফুলের নাম-না-জানা একটা পাতলা গন্ধ।
টেবিল-ল্যাম্পের আলো উপবিষ্ট ব্যারিস্টারের চোখে মুখে কপালে এসে পড়েছে। হাতদুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা।