জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হঠাৎ ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করতে চাস কেন?
কিরীটী বলেছিল, দোষ কি! তাছাড়া মানুষ-জনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় থাকাটা তো খারাপ নয়। বিশেষ করে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মত একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের সঙ্গে।
বুঝলাম, কিন্তু—
এর মধ্যে আবার কিন্তু কি?
অন্য কেউ হলে কি আর কিন্তু উঠত, এ কিরীটী রায় কিনা! হেসে জবাব দিয়েছিলাম। মোটকথা আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম, এই হঠাৎ আলাপের ব্যাপারটা একেবারে এমনই নয়, এর পশ্চাতে একটা বিশেষ কারণ আছেই। কিরীটীর চরিত্র তো আমার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সেদিনও যেমন সে কিছু ভেঙে স্পষ্ট করে জানায়নি, আজও জানাবে না এমন ভেবেই আর কোন প্রশ্ন না করে বসে রইলাম।
গাড়ি চলেছে মধ্যগতিতে।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, বাড়ি যাবি নাকি?
তা যেতে হবে বৈকি।
হীরা সিং, সুব্ৰতর বাড়ি হয়ে চল।
হীরা সিং নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল গাড়ি চালাতে চালাতেই।
.
বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল বটে কিরীটী কিন্তু মনটা সুস্থির হল না। কেবলই ঘুরেফিরে কিরীটীর ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে সকালের আলাপের কথাটা মনে পড়তে লাগল। আর সেই সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে উঠতে লাগল, ভুজঙ্গ ডাক্তারের সেই চেহারাটা। খাওয়া-দাওয়ার পরই গাড়ি নিয়ে কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম।
এসে দেখি কিরীটী একা একা তার বাইরের ঘরে সোফার উপরে বসে এক প্যাকেট তাস নিয়ে তাসের ঘর তৈরির মধ্যে ড়ুবে আছে। পায়ের শব্দে চোখ না তুলেই বলল, আয় সুব্রত, বস্।
কিরীটীর কথায় হঠাৎ যেন নতুন করে চোখের উপর স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল ভুজঙ্গ চৌধুরীর সরীসৃপসদৃশ চেহারাটা ও সেই সঙ্গে তার সেই কুৎসিত হাসির কথাটা। ব্যাপারটা স্মরণ হতেই গা-টা যেন কি এক ক্লেদাক্ত অনুভূতিতে ঘিনঘিন করে উঠল।
বললাম, তোর কেমন লাগল কিরীটী লোকটাকে?
কিরীটী চোখ বুজে ছিল সোফার গায়ে হেলান দিয়ে। সেই অবস্থাতেই বলল, আমার?
ছোটবেলায় টুনটুনির গল্পের বইয়ে পড়া সেই সাক্ষী শেয়ালের কথা মনে পড়ছিল লোকটাকে দেখে। মনে আছে তোর গল্পটা?
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল গল্পটা, বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি ব্যাপারটা কি বল তো?
কিসের ব্যাপার?
বলছি হঠাৎ ভুজঙ্গ-ভবনে আজ হানা দিয়েছিলি কেন?
কেন হানা দিয়েছিলাম?
হুঁ।
অবশ্যই একটা উদ্দেশ্য ছিল।
কথাটা বলে কিরীটী এতক্ষণে মুখ খুলল।
০৩. বর্তমান কাহিনীর আদিপর্ব
অতঃপর কিরীটীর মুখেই শোনা বর্তমান কাহিনীর আদিপর্বটা হচ্ছে:
বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়, যার মাসিক আয় কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার টাকা, তাঁরই একমাত্র মাতৃহারা পুত্র নব্য ব্যারিস্টার, বাপেরই জুনিয়ার অশোক রায়। এবং কিরীটীর বর্ণিত কাহিনীটা তাঁরই সম্পর্কে।
বছর তিনেক হবে মাত্র অশোক রায় বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসে বাপের জুনিয়র হিসেবেই আদালতে যাতায়াত শুরু করেছেন।
এবং বাপের তদ্বিরে ও চেষ্টায় আয়ও হতে শুরু করেছে।
বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট এবং অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির ছেলেটি। দেখতে-শুনতেও সুপুরুষ। এখনও বিবাহ করেননি। তবে গুজব শোনা যাচ্ছে হাই-সোসাইটি-গার্ল, বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট স্বর্গীয় ডাঃ অমল সেনের সুন্দরী তরুণী কন্যা মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি কিছুদিন যাবৎ একটা ঘনিষ্ঠতা দেখা দিয়েছে অশোক রায়ের।
সেই সূত্র ধরেই অভিজাত মহলে এমন কথাও কানাকানি চলেছে যে, এতকাল পরে সত্যি সত্যি নাকি বোহেমিয়ান মিত্রা সেন ঘব বাঁধবেন কিনা সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেছেন।
মিত্রার বাবা ডাঃ অমল সেন, ডি.এ.সি. একদা ইণ্ডিয়ান এড়ুকেশন সার্ভিসে ছিলেন, রিটায়ার করে আবার সরকারী বিশেষ একটি দপ্তরেই আরও বেশি মাহিনায় নতুন পোস্টে দিল্লীতে জয়েন করেছিলেন কিন্তু বেশিদিন তাঁর সে চাকরি করবার সুযোগ হয়নি। গত বৎসর মারা গিয়েছেন হঠাৎ রক্তচাপের ব্যাধিতে স্ট্রোক হয়ে।
এবং মৃত্যুকালে তিনি বেশ একটামোটা টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও কলকাতার উপরে বালিগঞ্জ অঞ্চলে চমৎকার একখানা বাড়ি রেখে গিয়েছেন।
তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে ঐ মিত্রা।
মিত্রাই সবার কনিষ্ঠ।
ডাঃ সেনের দুই ছেলেই অর্থাৎ মিত্রার দুই দাদা একজন নামকরা অধ্যাপক ও একজন ইনজিনীয়র বড় চাকুরে। বাপের সঞ্চিত অর্থ তো ছিলই, নিজেরাও বেশ ভালই অথোপার্জন করেন দুই ভাইই। কাজেই সংসারে সচ্ছলতার অভাব নেই। মিত্রার আট বৎসর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বর্তমানে মিত্রার বয়স ত্রিশ হলেও প্রায় কাছাকাছি, যদি কেউই সে সংবাদটি জানে না। কারণ দেখলেও বোঝবার উপায় নেই। মিত্রা এম. এ. পাস। দেকতে বা তার গাত্রবর্ণ যাই হোক না কেন, চোখেমুখে চলনে-বলনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে তার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিপছিপে মেয়েটি হাই-সোসাইটির মধ্যমণি হিসাবে বিরাজ করছে অনেক দিন ধরে। বৌদিরাও মিত্রাকে ভালবাসে এবং তার দাদারাও মিতা বলতে অজ্ঞান। স্নেহে একেবারে অন্ধ। বালিগঞ্জে লেক টেরেসে বৈকালী সাঞ্জ ক্লাবের সঙ্ঘমিত্রা মিত্রা সেন। তাছাড়া কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকাও। বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবের মেম্বার হচ্ছে অভিজাত ধনী সম্প্রদায়ের ছেলে ও মেয়েরা।
সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রবেশ সেখানে অসম্ভব, কারণ চাঁদের হার প্রতি মাসে একশতর নিচে নয়।