নিশ্চয়ই। আচ্ছা, বলছিলাম আপনি ব্যারিস্টার অশোক রায়কে বোধ হয় চেনেন? কিরীটীর প্রশ্নে দ্বিতীয়বার স্পষ্ট দেখতে পেলাম ডাক্তারের চোখের তারা দুটো মুহূর্তের জন্য যেন ঝিকিয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই শান্ত গলায় জবাব দিলেন, হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
চেনেন তাহলে? কতদিন চেনেন?
তা বছরখানেক তো হবেই।
বছরখানেক!
হ্যাঁ।
যদি কিছু মনে না করেন তো ঐ অশোক রায় সম্পর্কেই, মানে—কিরীটী একটু ইতস্তত করে।
না না-বলুন না কি বলছেন?
আচ্ছা, আপনার সঙ্গে তাঁর কি সূত্রে ঠিক পরিচয়টা হয়েছিল যদি বলেন—
ডাক্তারের সঙ্গে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যা হয়।
অর্থাৎ রোগী হিসাবেই তো। তা তিনি
হুঁ। কিন্তু মিঃ রায়, আর বেশি প্রশ্ন করতে পারবেন না। জানেন তো ডাক্তার ও তাঁর রোগীর মধ্যে পরস্পরের সম্পর্কটা। বলে মৃদু হাসলেন ডাঃ চৌধুরী।
বলা বাহুল্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম।
থাক। আর বলতে হবে না, বুঝেছি। কিরীটী বললে।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন সবিস্ময়ে তাকালেন ডাঃ চৌধুরী কিরীটীর মুখের দিকে।
কেবল একটা কথার আর জবাব চাই। অশোক রায় প্রায়ই এখানে, মানে আপনার কাছে আসতেন, তাই না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
প্রায়ই বলতে অবিশ্যি আপনি ঠিক কি মীন করছেন জানি না মিঃ রায়, তবে মধ্যে মধ্যে এক-আধবার আসেন। কথাটা শেষ করে হঠাৎ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাঃ চৌধুরী এবারে বললেন, কেবল ঐ সংবাদটুকু জানবার জন্যই নিশ্চয়ই এত কষ্ট করে আজ এখানে আসেননি মিঃ রায় আপনি?
বিশ্বাস করুন ডক্টর চৌধুরী। সত্যি, ঐটুকুই আমার জানবার ছিল আপনার কাছে। বাকিটা
বাকিটা?
মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দিল, সেটা জানা হয়ে গিয়েছে।
অতঃপর দুজনেই যেন কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে। তারপর ডাঃ চৌধুরীই আবার স্তব্ধতা ভঙ্গ করেন, অবশ্য আপনি যদি কিছু মনে না করেন তো একটা প্রশ্ন ছিল আমার মিঃ রায়।
বলুন।
আমি যতদুর জানি অশোক রায় ব্যারিস্টার is a perfect gentleman!
নিশ্চয়ই। তাতে কোন সন্দেহই নেই আমারও।
কিন্তু সন্দেহ যে আপনিই মনে এনে দিচ্ছেন মিঃ রায়।
আমি?
কতকটা তাই তো। এ দেশে একটা প্রবাদ আছে নিশ্চয়ই জানেন, পুলিসে ছুঁলে আঠার ঘা। তা আপনি আবার তাদেরও পিতৃস্থানীয় বলে নিজের রসিকতায় নিজেই আবার মৃদু হাসলেন।
না না—সে সব কিছুই নয়। কিরীটী বোধ হয় আশ্বাস দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে চোখ ছিল আমার। স্পষ্ট বুঝলাম আশ্বাস হলেও সে আশ্বাসবাক্য ডাক্তারের মনে কোনরূপ দাগই কাটতে সক্ষম হয়নি। তথাপি মুখ ফুটেও আর কিছু তিনি বললেন না। কিরীটীর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন।
কিরীটীই আবার কথা বললে, আচ্ছা, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে ঢোকবার সময় লক্ষ্য করলাম, একবারে লাগোয়া, বলতে গেলে পাশাপাশি একই রকমের দুটো গেট।
তাই। দোতলায়ও এ-বাড়ির ঠিক আমারই মত পাশাপাশি চারটে ফ্ল্যাট। আমারটা ও আমার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে ওঠবার সিঁড়িটা কমন। তার পাশের ডাইনের দুটো ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে ওঠবার গেট হচ্ছে দ্বিতীয় গেটটা এবং সেটারও একটাই সিঁড়ি।
আপনার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়াটে আছে তো?
হ্যাঁ। একজন ইণ্ডিয়ান ক্রিশচান। মিঃ গ্রিফিথ। তার স্ত্রী মিসেস্ গ্রিফিথ ও তাদের একমাত্র তরুণী কন্যা—মিস নেলী গ্রিফিথ।
ওঃ! পাশের দুটো ফ্ল্যাটে?
ও দুটোতে একটায় আছে শুনেছি একটি ইহুদী পরিবার। অন্যটায় আর একটি ক্রিশ্চান ফ্যামিলি।
ভাল কথা। আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী, রাত্রে আপনার চেম্বারে কেউ থাকে না?
হ্যাঁ, থাকে বৈকি। চেম্বারের সঙ্গে আমার নিজস্ব একটা চার বেডের নার্সিংহোম আছে যে। রোগী থাকলে তারা থাকে আর থাকে নার্স ও কুক মাযোলাল ও দারোয়ান বা কেয়ারটেকার গুলজার সিং। কিন্তু এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন, ব্যাপার কি বলুন তো? আমার চেম্বার ও নার্সিংহোমে কোন রহস্যের গন্ধ পেলেন নাকি? বলে মৃদু হাসলেন আবার ডাক্তার চৌধুরী।
না না—সে-সব কিছু নয়।
দেখবেন মিঃ রায়, ডাক্তারের চেম্বারে কোন রহস্য উদঘাটিত হলে চেম্বারটিতে তো আমার তালা পড়বেই—সেই সঙ্গে এত কষ্টে এতদিনের গড়ে তোলা বেচারী আমার প্র্যাকটিসেরও গয়া হবে।
না না—এমনি একটা ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে একটু সাহায্য নিতে এসেছিলাম। কথায় কথায় আপনার ফ্ল্যাটের কথাটা উঠে পড়ল। আচ্ছা আর আপনাকে বিরক্ত করব না, এবারে তাহলে উঠি। ওঁঠ সুব্রত বলতে বলতে কিরীটী ও সেই সঙ্গে এতক্ষণের নীরব শ্রোতা আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
ডাক্তার চৌধুরী আমাদের তাঁর ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আচ্ছা নমস্কার। কিরীটী বললে। নমস্কার। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিরীটীর গাড়িতে এসে বসলাম।
হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।
ছুটির দিনের শহর। তবু লোক-চলাচল ও কর্মব্যস্ততার যেন অন্ত নেই।
কিরীটী গাড়িতে উঠে ব্যাক-সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। তাকালাম একবার তার মুখের দিকে। বুঝলাম কোন একটা বিশেষ চিন্তা তার মস্তিষ্কের গ্রে সেলগুলোতে আবর্ত রচনা করে চলেছে।
গত পরশুদিন দুপুরে হঠাৎ আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল ব্যাপারটা যে, সে ডাঃ চৌধুরীর সঙ্গে রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে দেখা করবার জন্য এবং আমাকেও সঙ্গী হিসাবে চায়।