মৃদু কণ্ঠে কিরীটী ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল, পিকিউলিয়ার! A nice curio! মূর্তিটা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন ডাক্তার সাহেব? বলতে বলতে তাকাল কিরীটী ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মুখের দিকে।
নির্বাক ডাঃ চৌধুরী।
শুধু তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির ফলার মত দৃষ্টি নিস্পলক কিরীটীর দৃষ্টির প্রতি নিবদ্ধ।
ঘরের মধ্যে যেন একটা বিশ্রী অস্বস্তিকর থমথমে ভাব।
কিরীটী স্থির অপলক দৃষ্টিতে ডাঃ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু দেখতে পেলাম তার ডান হাতটির আঙুলগুলো নিঃশব্দে মূর্তিটার মাথায় বুলিয়ে চলেছে।
স্তব্ধতা।
বরফের মতই জমাট বাঁধানো স্তব্ধতা।
চারজোড়া চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি পরস্পর পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ।
দুখানা তীক্ষ্ণ তরবারির ফলা যেন পরস্পরকে স্পর্শ করে আছে একে অন্যের মুহূর্তের অসর্তকতায় চরম আঘাত হানবার প্রতীক্ষ্ণয়।
সহসা একটা মৃদু পদশব্দ যেন মনে হল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। পদশব্দটা ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এসে খোলা দরজার গোড়ায় থামল। তারপরই দেখা গেল খোলা দরজার পথে এক অধাবগুষ্ঠিতা নারীমূর্তি।
আজও মনে আছে আমার, সে যেন একটা আবিভাব! মধ্যরাত্রি যেন মূর্তিমতী হয়ে স্বপ্নের পথ বেয়ে সেদিন আমার দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা এক স্বপ্নচারিণী নারীমূর্তি যেন।
গাত্রবর্ণ খুব পরিষ্কার না হলেও চোখে মুখে ও দেহে সেই নারীর রূপের যেন অবধি ছিল না।
মনোমোহিনী সেই নারীমূর্তি খোলা দরজার পথে কমধ্যে প্রবেশ করেই মুহূর্তমধ্যে যেন থমকে দাঁড়াল। এবং মুখে ফুটে উঠল একটা তার চাপা আশঙ্কা।
আসুন মৃদুলা দেবী!
ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটী মৃদু অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর।
কিন্তু কিরীটীর আহ্বানে কোন সাড়াই যেন জাগল না সেই প্রস্তরীভূত নারীমূর্তির মধ্যে।
আবার কিরীটী বললে, বসুন!
তথাপি নির্বাক সেই নারীমূর্তি।
এবারে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, নীচের গাড়ি থেকে অশোকবাবুকে ডেকে নিয়ে আয় তো সুব্রত!
আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম একটু যেন বিস্মিত হয়েই।
কিন্তু নীচে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই কখন একসময় অশোক রায় নিজের গাড়ি নিয়ে এসে তার মধ্যে বসে আছেন চুপটি করে।
বললাম, কিরীটী আপনাকে ওপরে ডাকছে, চলুন অশোকবাবু!
ঘরের মধ্যে আমি ও অশোকবাবু প্রবেশ করতেই কিরীটী বললে, আসুন অশোকবাবু। দেখুন তো, ঐ উনিই আপনার সেই মনীষা দেবী কিনা!
কিরীটীর কথায় অশোকবাবু এবার চোখ তুলে তাকালেন, ঘরের মধ্যেই একপাশে পাথরের মত নিঃশব্দে দণ্ডায়মান মৃদুলা দেবীর মুখের দিকে চেয়ে।
মৃদুলা দেবীও যেন কেমন বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন অশোক রায়ের মুখের দিকে। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
স্তব্ধ কয়েকটা মুহূর্ত। কেবল ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটার একঘেয়ে পেণ্ডুলামের টকটক শব্দ।
কি, চিনতে পারছেন না অশোকবাবু?
ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এবার মাথা নাড়ালেন অশোক রায়।
চিনেছেন?
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে বললেন, হ্যাঁ, উনিই। আমার মনে পড়েছে এখন, উনিই মিত্রার মৃত্যুর দিন বৈকালী সঙ্ঘে—
হ্যাঁ অশোকবাবু, কথাটা এবার কিরীটীই শেষ করে, ওঁকেই আপনি হলঘরে সেরাত্রে ঢুকতে দেখেছিলেন। আর শুধু তাই নয়, বাগানে সে রাত্রে মিত্রা সেনের dead body-র সামনে থেকে উনিই চক্রান্ত করে ভয় দেখিয়ে আপনাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি, যাতে করে আপনাকেই সকলেই মিত্রা সেনের হত্যাকারী বলে সহজেই মনে করতে পারেন!
তবে কি,–অর্ধস্ফুট আর্তকণ্ঠে কথাটা বলতে গিয়েও যেন শেষ করতে পারলেন না অশোক রায়।
হ্যাঁ, উনিই মিত্রা দেবীর হত্যাকারিণী। মৃদুলা দেবী এবং মীরা চৌধুরী একমেবাদ্বিতীয়ম্। কিন্তু উনি দুর্ভাগ্যক্রমে মিত্রা দেবীকে হত্যা করার অপরাধে আজ দণ্ড নিতে বাধ্য হলেও, আসল হত্যার পরিকল্পনাটা ওঁর নয়, হত্যার ব্যাপারে উনি instrument মাত্র ছিলেন। আসল পরিকল্পনাকারী বা হত্যাপরাধে অপরাধী হলেন উনি–আমাদের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
কিরীটী ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল একবার এবং তাঁকেই সম্বোধন করে বললে, কিন্তু এ আপনি কি করলে ডাঃ চৌধুরী! মানুষের সেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের নীচে ড়ুবে গেলেন!
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী নির্বাক।
২৪. বিস্মিত হতবাক সকলে
বিস্মিত হতবাক সকলে।
কিরীটী বলতে লাগল, হ্যাঁ, উনি! মৃদুলা দেবীরই সাহায্যে আমাদের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী তাঁর লাভের ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। হতভাগ্য রূপমুগ্ধ পুরুষদের ওঁরই সাহায্যে ব্ল্যাক-মেইলিং করতেন এবং নার্সিংহোমে ওঁরই হাত দিয়ে সরবরাহ করতেন হ্যাহিসিগারেট নেশাগ্রস্তদের। তারপর মিত্রা সেনকে হাতে পেয়ে বৈকালী সঙ্ঘের ব্যপারটা তাঁরই হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে গেল মিত্রা দেবী অশোকবাবুকে ভালোবাসায়। ভালোবাসার সুধারসে নতুন করে জেগে উঠলেন মিত্রা দেবী আর সেইটাই হল তাঁর কাল। পাছে তাঁর মুখ থেকে সব অতীতের সত্য কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে ভুজঙ্গ চৌধুরী মৃত্যুবাণ হানলেন মিত্রার বুকে। কৌশলে তাঁকে বৈকালী সঙ্ঘে আনিয়ে মৃদুলা দেবীর সাহায্যে বিষপ্রয়োগ করালেন। পূর্বেই বলেছি, অশোক রায় সে রাত্রে হলঘরে ঢুকে মনীষা দেবীকেই দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু মনীষা দেবী বা মৃদুলা দেবী ছদ্মবেশে থাকায় এবং অশোক রায় ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই মনীষা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ায় অশোক রায় সেরাত্রে তাঁকে চিনতে পারেননি।