ঐ চাবির গোছাটা হাতাবার জন্যই এত আয়োজন পরে জেনেছিলাম।
চাবির সাহায্যে তারপর সিঁড়ির কোলাপসিবল গেট খুলে আমরা নিঃশব্দ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।
দোতলা ও তিনতলার মধ্যে সিঁড়িতে আর একটি কোলাপসিবল গেট ছিল, সেটাও ঐ রিঙের একটি চাবির সাহায্যে খুলে আমরা তিনতলায় পা দিলাম।
দুটি ঘর পাশাপাশি।
দুটোরই দ্বার বন্ধ।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় দ্বারে আঘাত করল পর পর চারটি টুক-টুক শব্দে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দরজাটা খুলে গেল।
কি রে রাম–কথাটা বলতে গিয়ে শেষ না করেই সহসা ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী আমাদের তিনজনকে দরজার সামনে দেখে বিস্ময়ে যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
নমস্কার ডাঃ চৌধুরী। এত রাত্রে নিজের শয়নকক্ষের দোরগোড়ায় আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন!
মুহূর্তকাল স্তব্ধ থেকেই ভুজঙ্গ চৌধুরী যেন নিজেকে সামলে নিলেন এবং মৃদু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, তা একটু হয়েছি বৈকি।
ভাবছেন নিশ্চয়ই কি করে এখানে এত রাত্রে প্রবেশ করলাম!
না। কিন্তু বাইরে কেন, ভিতরে আসুন। কষ্ট করে এসেছেনই যখন।
ভুজঙ্গ চৌধুরীর পরিধানে তখন ছিল গ্রে রঙের ট্রপিক্যাল সুট। পায়ে রবারসোল দেওয়া জুতো।
সেই দিকেই তাকিয়ে কিরীচী বললে, এই ফিরছেন, না কোথাও বেরুচ্ছিলেন?
অনধিকার চর্চা ওটা আপনার মিঃ রায়। কিন্তু কেন এ গরীবের কুটিরে বে-আইনী ভাবে জুলুম করে এই অসময়ে আপনার মত মহাত্মার শুভাগমন, জানতে পারি কি?
জানাব বলেই তো আসা। শুনবেন বৈকি। তার আগে এই মিঃ লাহিড়ীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আবার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
ওঁকে আমি চিনি। পরিচয়ের কোন প্রয়োজন নেই। আপনার বক্তব্যটা তাড়াতাড়ি শেষ করলে বাধিত হব।
কথা বললেন এবার রজত লাহিড়ীই। বললেন, বৈকালী সঙ্ঘ ও আপনার চেম্বারে বিনা লাইসেন্সে হ্যাহিস্ নামক মাদক দ্রব্যের চোরাকারবার করবার জন্য আপনাকে আমি arrest করতে এসেছি ডাঃ চৌধুরী।
I see! তা এ মূল্যবান সংবাদটি কোথায় পেলেন? মিঃ কিরীটী রায়ই দিয়েছেন বোধ হয়?
সে জেনে আপনার কোনো লাভ নেই ডাঃ চৌধুরী। আপনি সরে আসুন, আপনার ঘরটা একবার সার্চ করতে চাই।
করতে পারেন, কিন্তু consequence-টাও মনে রাখবেন। অযথা একজন ভদ্রলোককে এভাবে বিব্রত করা আপনাদের আইনও নিশ্চয়ই সম্মতি দেয় না!
সে সম্পর্কে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। লাহিড়ী জবাব দিলেন।
আবার কিরীটী কথা বললে, তার আগে দয়া করে আপনি আপনার ছোট ভাই ত্রিভঙ্গবাবু ও তাঁর স্ত্রী মৃদুলা দেবীকে যদি একবার এখানে ডাকেন—
মিঃ রায়, অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছেন না কি! জবাবে বলেন ভুজঙ্গ চৌধুরী।
চোখরাঙানিতে বিশেষ কোনো ফল হবে না আর ডাক্তার সাহেব। যা বলছি তাই করুন। নচেৎ বাধ্য হয়ে আমাদেরই সে ব্যবস্থা করতে হবে জানবেন। আপনার মত একজন শয়তানী বুদ্ধিতে পরিপক্ক ব্যক্তির বোঝা উচিত যে প্রস্তুত হয়েই এখানে আজ আমরা এসেছি সব রকমে। মিথ্যে আর দেরি করে কোনো লাভ হবে না। যা বললাম করুন। কেন মিথ্যে চাকর-বাকরদের সামনে একটা scene create করবেন!
অতঃপর মুহূর্তকাল ডাঃ চৌধুরী কি ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু তাদের ডাকতে হলেও তো নীচে আমাকে যেতেই হবে।
নীচে যাবেন কেন? ঘরের মধ্যে কোনো কলিং বেল নেই আপনার?
কলিং বেল!
নিশ্চয়ই। দেখুন না একটু দয়া করে মনে করে। উপর-নীচ করাটাও আপনার বিশেষ অভ্যাস নেই বলেই আমি শুনেছি ডাক্তার সাহেব। চলুন, ঘরে ঢুকে ওঁদের আহ্বান করুন।
সে রকম কোনো ব্যবস্থাই আমার ঘরে নেই।
তবে দয়া করে সরুন। আমাকেই দেখতে দিন।
মুহূর্তকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ডাঃ চৌধুরী।
আপনিও ভেতরে চলুন। আমরা ভেতরে যাব আর আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, সেটা কি ভাল দেখাবে? চলুন! বলতে বলতে কিরীটী মৃদু হাসল।
সকলে মিলে আমরা যেন কতকটা ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীকে ঘিরেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
একটা ব্যাপার আজ প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, কিরীটীর চোখ ও কান যেন অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে আছে। তার দেহের প্রতিটি রোমকূপ যেন চক্ষু মেলে রয়েছে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে ঢুকে চকিতে সিলিং থেকে শুরু করে দেওয়াল ও মেঝে পর্যন্ত কক্ষের সর্বত্র তার তীক্ষ্ণ অতিমাত্রায় সজাগ দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিল বারকয়েক।
অত্যন্ত সাধারণ ও স্বল্প আসবাবপত্রে কক্ষটি যেন একেবারে ছিমছাম।
একপাশে একটি সিঙ্গল বেডিং। একটি স্টীলের আলমারি, একটি আরামকেদারা, একটি বিরাট আয়না দেওয়ালে টাঙানো ও বেডিংয়ের কাছে একটি ত্রিপত্রের ওপরে অদ্ভুত একটি বৃদ্ধের কাষ্ঠমূর্তি ও একটি কাঁচের জলভর্তি পাত্র। মূর্তিটি বিরাট উদরবিশিষ্ট এক বৃদ্ধের। উদরের দু পাশে দুটো হাত। দন্তপাটি বিকশিত। পা ভাঁজ করে বসে আছে। মাথায় একটি টুপি।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখলাম ঘরের সর্বত্র ঘুরে গিয়ে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত সেই কাষ্ঠনির্মিত বিচিত্র বৃদ্ধের মূর্তির উপরে স্থির হল।
কয়েক সেকেণ্ড মৃর্তিটার দিকে কিরীটী তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ত্রিপয়টার সামনে। দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে হাত রাখল মূর্তিটার গায়ে।
আমরা সকলে স্তব্ধ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।