সেই বৃদ্ধকে আপনি চিনতে পারেননি অশোকবাবু?
না।
কখনও দেখেননি পূর্বে?
না।
আপনার মত আর কেউ বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বার ঐ ধরনের খেসারত দিচ্ছেন বা দিয়েছেন। বলে জানেন?
আগে জানতাম না। পরে মিত্রা কয়েক দিন আগে আমাকে বলেছিল, বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যে আমার মত নাকি আরও অনেক victim ছিল।
হুঁ। আমি সেটাই আশা করেছিলাম। ভাল কথা, তাঁদের কারও নাম জানেন?
জানি। দু-তিনজনের—শ্ৰীমন্ত পাল, মনোজ দত্ত, সুপ্রিয়।
তাঁরাও তাহলে প্রতি মাসে টাকা দিতেন?
তাই তো শুনেছি।
কার হাতে টাকাটা আপনি দিতেন তুলে প্রতি মাসে?
বিশাখার হাতে, সে-ই আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যেত ছদ্মবেশে।
হুঁ।
অশোক রায় বর্ণিত কাহিনী যেন এক অবিশ্বাস্য রহস্যের দ্বারোদঘাটন করে চলেছে।
ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে যে রাত্রির প্রহরও গড়িয়ে প্রায় সাড়ে নটা বাজতে চলেছে, সেদিকে কারও যেন তখন খেয়াল নেই।
উপবিষ্ট অশোক রায়ের চোখে-মুখে একটা বিষণ্ণ ক্লান্তি। কিরীটী কেবল ঘরের মধ্যে
তখন উঠে পায়চারি করে চলেছে নিঃশব্দে।
প্রবল উত্তেজনায় যে তার দেহটা কাঁপছে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম।
কয়েকটা মুহূর্ত আবার স্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল।
হঠাৎ আবার কিরীটীই অশোক রায়ের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, এখন বুঝতে পারছি অশোকবাবু, এতকাল পরে এক উজ্জ্বঙ্খল নারীর মধ্যে আপনি সত্যিসত্যিই চিরন্তন স্নেহময়ী, প্রেমলিন্দু নারীত্বকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। সত্যিই সে আপনার প্রেমের স্পর্শে বিস্মরণ থেকে জেগে উঠেছিল।
বুঝতে পেরেছি আপনি মিত্রার কথা বলছেন, বলতে বলতে অশোক রায়ের চোখের কোণ দুটো অশ্রুতে ছলছল করে ওঠে। তারপর একটু থেমে বিষণ্ণ করুণ কণ্ঠে বলে, আমি সেটা জানতে পেরেছিলাম বলেই তার অতীতের সমস্ত দোষ-ক্রটি সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম মিঃ রায়। কিন্তু কোথা থেকে হঠাৎ কি হয়ে গেল! অশোক রায়ের কণ্ঠস্বর যেন শেষটায় আর শোনা গেল না, কান্নায় বুজে এল।
কথা বললে আবার কিরীটী, আর ঠিক সেই জন্যই তাঁকে এমনি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হল অশোকবাবু। এতকাল যে শয়তান সেই নারীর মন ও দেহকে নিয়ে নিষ্ঠুর ব্যবসা খুলে বসেছিল সে সেটা সহ্য করতে পারল না এবং ভবিষ্যতে যাতে আরও রহস্য তার দ্বারা বাইরে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, সেই কারণেই আপনার ও মিত্রা দেবীর মিলনের মুহূর্তে সে মিত্রা দেবীকে সংহার করল নিজের সেফটির নিরাপত্তার জন্য। এমনিই হয় অশোকবাবু। পাপের পথ দুষ্কৃতির পথ,বড় পিছল, বড় ভয়াবহ। একবার সে পথে পড়লে ফেরা বড় কঠিন। এবং ফিরতে গেলেও এমনি করেই তাকে মূল্য দিতে হয়। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে আর একটি প্রশ্ন আমার আপনাকে জিজ্ঞাস্য আছে।
নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালেন অশোক রায়।
ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীকে আপনি চিনতেন?
হ্যাঁ।
তাঁর চেম্বারে ও নার্সিং হোম সম্পর্কে আপনি কিছু আমাকে বলতে পারেন?
খুব বেশী আমি জানি না মিঃ রায়, তবে বৈকালী সঙ্ঘের অনেক মেম্বারই মধ্যে মধ্যে রাত এগারোটার পর সেখানে যাতায়াত করতেন।
কেন তাঁরা যাতায়াত করতেন বলতে পারেন?
না।
আপনিও তো মধ্যে মধ্যে সেখানে যেতেন?
হ্যাঁ গিয়েছি।
কেন?
জবাবে কেন জানি এবারে অশোক রায় চুপ করে রইলেন মাথা নিচু করে।
বুঝতে পারছি অশোকবাবু, কোনো কিছুর একটা আকর্ষণ আপনারও সেখানে ছিল। বুলতে আপনি দ্বিধা করছেন। বেশ, কথাটা আরও স্পষ্ট করেই তাহলে বলি, কোনো মাদক দ্রব্যের বা ঐ জাতীয় কোনো কিছুর বেচা-কেনার ব্যাপার কি সেখানে আছে?
এবারে যেন সত্যিই চমকে ওঠেন অশোক রায়। বিহ্বল জড়িত কণ্ঠে বলেন, কিন্তু আপনি—আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
যদি বলি, নিছক সেটা আমার একটা অনুমান মাত্র?
অনুমান!
হ্যাঁ।
মাদক দ্রব্য কিনা জানি না মিঃ রায়, তবে এক ধরনের স্পেশাল-ব্র্যাণ্ড ইজিপ্সীয়ান সিগারেট কেনবার জন্য কেউ কেউ আমরা সেখানে যেতাম।
সিগারেট?
হ্যাঁ।
যাক আর আমার কিছু আপনাকে জিজ্ঞাস্য নেই। আপনি এবারে যেতে পারেন। কেবল একটা অনুরোধ, এই মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি কলকাতা ছেড়ে কোথায়ও যাবেন না দয়া করে।
বেশ তাই হবে।
২৩. অশোক রায় বিদায় নিলেন
অতঃপর অশোক রায় বিদায় নিলেন।
ঐদিন রাত বারোটার পর কিরীটীর পূর্ব পরিকল্পনামত আমরা ছোট একদল সশস্ত্র পুলিস-বাহিনী নিয়ে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর আমীর আলী অ্যাভির আবাসস্থলে গিয়ে ঘেরাও করলাম।
এবং আমি, কিরীটী ও লাহিড়ী তিনজনে মিলে সদর দরজায় উপস্থিত হয়ে, কিরীটীর নির্দেশে আমিই দরজার গায়ে কলিং বেলের বোতামটা টিপলাম।
বলা বাহুল্য আমরা তো সাধারণ বেশে ছিলামই, লাহিড়ীও ছিলেন সাধারণ বেশে।
কিছুক্ষণ বাদেই দরজা খুলে দিল ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর খাসভৃত্য রাম।
কে আপনারা, কি চান?
কিরীটী জবাব দিল, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
রাত্রে তো তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
করবেন। তুমি তাঁকে গিয়ে বল কিরীটী রায় এসেছেন, দেখা করতে চান। জরুরী।
মিথ্যে আপনি বলছেন বাবু। স্বয়ং মহারাজা এলেও রাত্রে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
ইতিমধ্যে কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত তার নিযুক্ত লোকটি ডাক্তারের বাড়ির ছদ্মবেশী ভৃত্য রামের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং আচমকা পিছন দিক থেকে রামকে আক্রমণ করতেই কিরীটীও তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে গেল লাফিয়ে। রাম কোনরূপ শব্দ করবার পূর্বেই তাকে হাত-মুখ বেঁধে বন্দী করা হল। এবং সেই ছদ্মবেশী ভৃত্যই তখন রামের কোমর থেকে চাবির গোছা ছিনিয়ে নিল।