বাধা দিলাম এবারে আমি। তাই যদি হয় তাহলে বুঝতে পেরেছি, তুই কি বলতে চাস! প্রথমত বৈকালী সঙ্ঘের বাড়িতে ঢোকবার একটিমাত্র দ্বারপথ ছাড়া আর দ্বিতীয় দ্বারপথ নেই বলেই আমরা শুনেছি এবং মিত্রা সেনের পূর্বে কেউ আর এসেছিল বলেও শশী হাজরা বলেনি। তাহলে এক্ষেত্রে দুটি কথাই ভাবতে হবে। এক—হয় এই মেইন ডোর ছাড়াও সঙ্ঘের বাড়িতে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো দ্বারপথ আছে নিশ্চয়ই, যে ব্যাপারটা হয়তো মেম্বাদের কাছেও গোপন ছিল। দ্বিতীয় শশী হাজরা সত্য statement দেয়নি। শুধু তাই নয়, আরও একটা ভাববার কথা আছে। অশোকবাবুবৈকালী সঙ্ঘের একজন পুরাতন influential মেম্বার। এবং সঙ্ঘে একমাত্র মেম্বারদের ছাড়া যখন বাইরের কারোরই প্রবেশের কোনোরকম অধিকারই ছিল না, সেক্ষেত্রে এমন কে নারী গত সন্ধ্যায় হলঘরে উপস্থিত ছিলেন যিনি অশোকবাবু ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই তিন নম্বর দ্বারপথ দিয়ে হলঘর থেকে বের হয়ে যান এবং অশোকবাবুও যাঁকে চিনতে পারলেন না! যাক তাহলে আপাতত আমরা একটা ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি যে, মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন গতরাত্রে সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিট থেকে সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই।
তাহলে তো অশোকের উপরে কোন সন্দেহই পড়তে পারে না মিঃ রায়!
এতক্ষণে যেন হালকা হয়ে রাধেশ রায় কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন।
না, প্রথম থেকেই আমি স্থিরনিশ্চিত ছিলাম যে অশোকবাবু হত্যা করেননি মিত্রা সেনকে। এবং সেটা সম্পর্কে ডবল করে নিশ্চয় হয়েছি ওঁর একটি মাত্র কথা শুনেই একটু আগে।
কথাটা যে কি, অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মিত্রা সেনের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে একটু আগে যে অশোক রায়ের গলা ধরে এসেছিল, কিরীটীর নিশ্চয়তার পিছনে তারই ইঙ্গিত ছিল।
কিরীটী অতঃপর তার প্রশ্ন শুরু করেছে তখন।
অশোকবাবু, মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর আপনি যখন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তখন কি কেউ আপনাকে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিল?
মৃদুকণ্ঠে অশোক রায় প্রত্যুত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
কে সেই নারী?
মহারানী সুচরিতা দেবী বলেই আমার মনে হয়।
মহারানী?
হ্যাঁ। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট তাঁকে দেখতে পাইনি। তাছাড়া মনের অবস্থাও তখন আমার এমন ছিল না যে তাঁর সম্পর্কে ভাবি। তবে মনে হয় তিনিই।
না অশোকবাবু, মহারানী নন।
তবে? তবে কে তিনি?
এ সেই নারী সম্ভবত যাকে আপনি গতকাল হলঘরে ঢুকেই দেখতে পেয়েছিলেন মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু–
আমার মন বলছে তাই। কিন্তু যাক সে কথা। আপনি হঠাৎ আত্মগোপন করেছিলেন কেন?
কারণ তিনিই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আত্মগোপন না করলে মিত্রার হত্যাকারী বলে আমাকেই লোকে ভাববে। আর সেই কথা শুনে আমারও যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল, আমি তাড়াতাড়ি পালালাম।
আপনি যাবার সময় নিশ্চয়ই হলঘর দিয়ে যাননি?
না। প্রেসিডেন্টের ঘরের পাশ দিয়ে যে প্যাসেজ, সেই প্যাসেজ দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিলাম।
কেউ আপনাকে বের হয়ে যাবার সময় দেখেছিল বলে আপনি জানেন?
অত লক্ষ্য করে দেখিনি।
স্বাভাবিক। বলে একটু থামল কিরীটী। মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবল, তারপর মৃদুকণ্ঠে আবার বললে, অশোকবাবুকে এবারে আমার যা জিজ্ঞাস্য, সেটা আমি রাধেশবাবু আপনার অনুপস্থিতিতেই করতে চাই।
বেশ আমি যাচ্ছি। আমি গাড়িতেই অপেক্ষা করছি। রাধেশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু অশোক রায় বাধা দিলেন, না বাবা, তুমি বাড়ি চলে যাও আমি পরে যাচ্ছি।
রাধেশ রায় ইতস্তত করেন। কিরীটী ব্যাপারটা বুঝে বলে, আপনি যান রাধেশবাবু, উনি পরেই যাবেনখন।
রাধেশ রায় আর দ্বিরুক্তি করলেন না। ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।
২২. সোফার উপরে নিঝুম হয়ে
অশোকবাবু!
সোফার উপরে নিঝুম হয়ে মাথা নীচু করে বসেছিলেন অশোক রায়।
কিরীটীর ডাকে মুখ তুলে তাকালেন, বলুন!
গত প্রায় বৎসরখানেক ধরে প্রতি মাসের প্রথমদিকে আপনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিতেন। যদি আমাকে সে সম্পর্কে একটু enlighten করেন!
ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে থেকে ধীরে ধীরে একসময় অশোক রায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবই যখন আপনাকে বলছি মিঃ রায়, সে কথাও বলব আপনাকে।
হ্যাঁ, বলুন–
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। একটা কুৎসিত জঘন্য চক্রান্তের মধ্যে কৌশলে আমাকে ফেলে দীর্ঘদিন ধরে আমাকে ব্ল্যাকমেইলিং করা হচ্ছে। বলে একটু থেমে পুনরায় শুরু করলেন অশোক রায়, বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যে মধ্যে বাগান-পার্টি হয়, কলকাতার বাইরে ব্যারাকপুরের এক বাগানবাড়িতে।
একটা কথা, সেই বাগানবাড়িটা কার,জানেন কিছু?
না।
বেশ, বলুন তারপর?
বৎসর দুই আগে সেই রকমই এক পার্টিতে মনীষা দেবী নামে এক অত্যাশ্চর্য নারীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। বলতে আপনাকে দ্বিধা নেই মিঃ রায়, অমন অদ্ভুত intelligent নারী ইতিপূর্বে বড় একটা আমার চোখে পড়েনি। মনীষা দেবীর এমন কিছু একটা বিস্ময়কর আকর্ষণ ছিল যা মুহূর্তমাত্রে যে কোনো পুরুষকেই আকর্ষণ করতে পারে। কোনো সংকোচ না করেই বলছি, আমিও আকর্ষিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল জীবনে তার দেখা না পেলে বোধ হয় জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যেত। And what a fool I was! যাক যা বলছিলাম। সেই পার্টির দিন রাত্রেই, সন্ধ্যার পর থেকেই কি ঝড়বৃষ্টি সেদিন! পাটির সকলেই প্রায় চলে গিয়েছিল তখন, কেবল সে বাড়িতে ছিলাম আমি ও মনীষা দেবী। দোতলার নিভৃত যে ঘরটিতে বসে আলাপ করছিলাম তার আলো নিবিয়ে দেওয়া হয় হঠাৎ। এবং হঠাৎ আলো নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আচম্বিতে মনীষা দেবী আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেন ও সেই মুহূর্তেই অন্ধকারে ক্যামেরার ফ্লাশবাল্ব জ্বলে ওঠে। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে ওঠবার আগেই আবার আলো জ্বলে উঠল ও সঙ্গে সঙ্গে মনীষা help! help! বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তার চিৎকারে সকলে ঘরে এসে প্রবেশ করল। তার মধ্যে এক বৃদ্ধ ছিলেন যাঁকে ইতিপূর্বে সেদিন পার্টিতে দেখিনি। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মনীষা তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললে, আমি নাকি তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করতেই ঐ ঘরে এসেছিলাম। বুঝতেই পারছেন তখন আমার অবস্থা। সেই ঘটনারই খেসারত দিয়ে চলেছি মাসে মাসে এখনও মিঃ রায়।