মুহূর্তে ডাক্তার চৌধুরীর পিঙ্গল চোখের তারায় যেন একটা হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে মুখেও তাঁর হাসি ফুটে ওঠে।
আবার আমি আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম। একটা ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল অনুভূতি যেন আমার সর্বদেহে ছড়িয়ে গেল।
ডাক্তার তখন আবার বলছিলেন, বলেন কি মিঃ রায়! ডাক্তারদের তো শুনি লোকে যতটা পারে এড়িয়েই চলে। নেহাৎ বিপদে বা বেকায়দায় না পড়লে তাদের সামনাসামনি কেউ বড় একটা আসে বলে তো জানি না।
ডাক্তারদের ডাক্তারিটাই তো একমাত্র পরিচয় নয় ডক্টর চৌধুরী! বলে কিরীটী।
কিরীটীর জবাবে মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর চৌধুরী, তারপর মৃদু হেসে বললেন, কথাটা হয়ত আপনার মিথ্যা নয় মিঃ রায়। কিন্তু লোকে তো সেটা ভুলেই যায়। আমরাও যেন ভুলতে বসেছি।
সেটা কিন্তু বলব আপনাদেরই নিজেদের সেম প্রফেশনের লোকেদের উপরে একটা বিশেষ পক্ষপাতিত্ব। আর সেই কারণেই বোধহয় চট করে বড় একটা কেউ আপনাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না।
সত্যি, আপনারও তাই মনে হয় নাকি! বলতে বলতে নিঃশেষিত-প্রায় জ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশটুকুর সাহায্যেই টিন থেকে একটা নতুন সিগারেট টেনে অগ্নিসংযোগ করে টিনটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, চলে নিশ্চয়ই?
ধন্যবাদ। চলে। তবে আমি সিগার আর পাইপই লাইক করি। বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে চামড়ার সিগারকেসটা বের করে একটা সিগার নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
What about you Subrata baboo? বলে ডাক্তার আমার দিকে টিনটা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাসলেন।
No! Thanks! বলে সঙ্গে সঙ্গেই আমি আবার দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম।
ওঃ, বলেন কি মশাই! ধূমপান করেন না।
না। দু-একবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু রপ্ত করতে পারলাম না। বলে হাসলাম। আমিও একসময় সিগার চেষ্টা করেছিলাম মিঃ রায়, কিরীটীর দিকে তাকিয়ে এবারে ডাক্তার বলতে লাগলেন, কিন্তু গন্ধটা এমন উগ্র যে সুব্রতবাবুর মতই রপ্ত করতে পারলাম না। এবং কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলের গায়ে সংযুক্ত কোন অদৃশ্য প্রেসবটম টিপতেই কঁ কঁ করে একটা শব্দ হল ও তার পরমুহূর্তেই ঘরের মধ্যকার তৃতীয় দ্বারটি খুলে একটি মধ্যবয়সী নার্স ঘরে ঢুকে ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়াল, আদেশের অপেক্ষায়।
টি প্লিজ, নার্সকে কথাটা বলেই ডাক্তার ফিরে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে এবং প্রশ্ন করলেন, চা চলবে তত মিঃ রায়?
আপত্তি নেই।
সুব্রতবাবু আপনি—
হেসে বললাম, আপত্তি নেই।
নার্স চলে গেল ঘর থেকে পূর্ব দ্বার-পথে।
আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাঃ চৌধুরী কথা বললেন, মিঃ রায়, আপনার ও সুব্রতবাবুর চেহারা সংবাদপত্র মারফৎ এতবার দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে যে, দেখামাত্রই আজ আপনাদের আমার সেইজন্যই চিনে নিতে কষ্ট হয়নি।
কিরীটী ধূমপান করতে করতে নিঃশব্দে হাসল মাত্র, কোন জবাব দিল না।
একটু পরেই বেয়ারা ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। এবং ট্রেটা ডাক্তারের সামনে নামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দেই আবার চলে গেল।
ডাক্তারই উঠে নিজহাতে চিনির পরিমাণ জেনে নিয়ে তিন কাপ চা তৈরী করে দু কাপ আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে তৃতীয় ও অবশিষ্ট কাপটি তুলে নিলেন।
চা পানের সঙ্গে সঙ্গেই গল্প চলতে লাগল।
একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম ডাক্তার যাকে বলে একেবারে চেইন স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছেন। আবার মনে হল লোকটা এত বেশী ধূমপান করে, অথচ ওর দাঁতগুলো অমন ঝকঝক করছে কি করে! কোন দাঁতে কোথাও এতটুকু নিকোটিনের ছোপ মাত্রও নেই!
রবিবারে এভাবে দেখা করতে এসে আপনাকে বিব্রত করলাম না তো ডক্টর চৌধুরী। কিরীটী বলে।
না, না—বিব্রত কেন করবেন। রবিবারে অবিশ্যি পূর্ব হতে কোনোস্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে গাড়িটা নিয়ে একা একাই বের হয়ে পড়ি। সমস্তটা দিন কলকাতার বাইরে এই ইট-কাঠ-পাথরের প্রাণান্তকর সভ্যতার হৈ-হট্টগোলের সীমানা পার হয়ে, কোথাও কোনো খোলা জায়গায় গিয়ে কাটিয়ে আসি। ঐ ভাবে একটা কোনও নির্জন জায়গায় ঘণ্টাকয়েক কাটানোর মধ্যে যে কত বড় একটা রিলিফ পাই—সে জানি একমাত্র আমিই। কিন্তু পরশু আপনার ফোন না পেয়ে এবং এ রবিবার সকালে কোনোস্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকায় আপনাদের আমি আসতে বলেছিলাম আজ। তাছাড়া আপনি আমার সঙ্গে নিজে থেকে দেখা করে আলাপ করতে আসছেন, সে লোভটাও তো কম নয় মিঃ রায়। সুযোগটাকে তাই সাদরে আহ্বান জানাতে এতটুকু কিন্তু দ্বিধা করিনি। কিন্তু থাক সে কথা। আপনার মত একজন লোক যে কেবল আমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যই এসেছেন কথাটা কেমন যেন শুধু তাই মনে হচ্ছে না মিঃ রায়, নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণও কিছু একটা আছে। বলে ডক্টর চৌধুরী তাকালেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে।
হাসল কিরীটী। বললে, একেবারে আপনার অনুমানটা যে মিথ্যে তা নয় ডক্টর চৌধুরী। সত্যিই কতকটা নিজের তাগিদেই আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি।
না, না—সে কি কথা! বলুন না কি প্রয়োজন আপনার? কৌতূহলে ডাক্তারের পিঙ্গল দুটো চোখের তারা যেন বারেকের জন্য ঝিকিয়ে উঠল।
কিরীটী চুরুটের অগ্রভাগটা সামনের টেবিলের উপর রক্ষিত অ্যাশট্রের মধ্যে ঠুকতে ঠুকতে মৃদুকণ্ঠে বললে, ডক্টর চৌধুরী, তাহলে আমার কাজের কথাটাও সেরে ফেলি, কি বলেন?