মিঃ রায়, আপনি যে আপনার একমাত্র পুত্রস্নেহে অন্ধ সেকথা তো আমার অজানা নয়। শুনুন রাধেশবাবু, আজ সকালে যে পাঞ্জাবী ড্রাইভার অশোকবাবুর গাড়িটা নিয়ে এসে গ্যারেজে গাড়ি রেখে সোজা আপনার বাড়ির অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করেছিল আমি তার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এই যে টেলিফোন আছে ওখানে। ফোনে তাকে এখুনি একবার এখানে ডেকে আনবেন কি?
কিরীটীর কথায় দিশেহারা বিবশ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত রাধেশ রায় তাকিয়ে থাকেন তার মুখের দিকে নিঃশব্দে। তারপর মৃদু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন, পাঞ্জাবী ড্রাইভার!
হ্যাঁ। আপনি জানেন না রাধেশবাবু, গতরাত থেকেই প্লেন ড্রেসে আমার লোক আপনার বাড়ির প্রহরায় ছিল। এবং এখনও আছে। তারা আপনার গৃহের প্রতিটি খুঁটিনাটির ওপর নজর রেখেছে। তারাই যথাসময়ে রিপোর্ট দিয়েছে।
কিন্তু আমার বাড়িতে তো কোন পাঞ্জাবী ড্রাইভার নেই। একজন মাত্র ড্রাইভার,বাঙালী,
সেও আমারই গাড়ি চালায়। অশোক বরাবর তার নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করত। তার তো কোন ড্রাইভারই আজ পর্যন্ত নেই।
তাও আমার অজানা নয়। তাই তো আমি জিজ্ঞাসা করছি, পাঞ্জাবীর ছদ্মবেশে তাহলে সে ব্যক্তিটি কে, যে আজ সকালে আপনার ছেলের গাড়িটা গ্যারেজে এনে তুলে আপনার বাড়ির ভেতরই অদৃশ্য হয়ে গেল?
আপনি যে কি বলছেন মিঃ রায়, বুঝতেই পারছি না! ব্যাপারটা আগাগোড়া আমার কাছে যে গল্পের মতই মনে হচ্ছে!
গল্প নয় রাধেশবাবু, নিষ্ঠুর সত্য–বলতে বলতে হঠাৎ পকেট থেকে একখানা ফটোগ্রাফ চকিতে বের করে আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আলোটা জ্বেলে দে সুব্রত।
নিঃশব্দে উঠে আমি ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলাম সুইচ টিপে, কেননা ইতিমধ্যেই ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ চাপ বেঁধে উঠেছিল।
হাতের ফটোটা নিঃশব্দে সম্মুখে উপবিষ্ট রাধেশ রায়ের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কিরীটী পূর্ববৎ শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললে, এই ফটোটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখুন রাধেশবাবু। সেই ড্রাইভারটি যখন গ্যারেজে গাড়ি রেখে অন্দরে প্রবেশ করছিল, সেই সময়ই আমার লোক দূর থেকে তার এই ফটোটা তুলে নিয়েছে। ঘণ্টা তিনেক আগেই মাত্র এটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা, এই লম্বা লোকটি, মাথায় পাগড়ি—এ কে?
নির্বাক বিহ্বল বোবা দৃষ্টিতে রাধেশ রায় কিরীটীর দেওয়া ফটোটা হাতে নিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সুট পরিহিত দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি, মাথায় পাঞ্জাবীদের মতন পাগড়ি, অন্দরের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে উদ্যত, ঐ সময়ই স্ন্যাপটা নেওয়া হয়েছে।
ঘরের মধ্যে একটশ অদ্ভুত স্তব্ধতা। কেবল দেওয়ালঘড়ির পেণ্ডুলামটা একঘেয়ে টকটক শব্দ জানিয়ে চলেছে।
কি, জবাব দিন রাধেশবাবু! এ লোকটিকে এখন পর্যন্ত আপনার বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়নি। কে এ লোকটি?
রাধেশ রায় তথাপি নির্বাক।
এ হয়তো আপনার ছেলের খবর জানে। আমি এর সঙ্গে কথা বলতে চাই। দয়া করে ফোনে এখানে লোকটিকে একবার ডাকবেন কি! আবার কিরীটী বলে।
রাধেশ রায় পূর্ববৎ নিশ্চুপ।
শুনুন রাধেশবাবু, মাসখানেক আগে একদিন আপনি ব্যাকুল হয়ে এবং আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তিত হয়েই সাহায্যের জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এবং আজ বলতে বাধা নেই, আপনার মুখে সেদিনকার সেই কাহিনী শুনেই সেদিন তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকখানিই এগুতে হয়েছিল আমাকে পরে। যার ফলে আমাকে ঘটনাচক্রে শেষ পর্যন্ত এমন একটা ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যার পশ্চাতে আমি অনুসন্ধানের দ্বারা জানতে পেরেছিলাম যে, একটা বিরাট ব্ল্যাক মেইলিংয়ের প্ল্যান রয়েছে। এবং শুধু আপনার ছেলে অশোকবাবুই নন, আরও অনেকেই সে প্ল্যানের মধ্যে, পরে জানতে পারি যে, অলক্ষ্যে জড়িয়ে পড়ে শোষিত হয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এবং সেই রহস্য উদঘাটনের জন্য এগুতে এগুতে হঠাৎ এক বিষধর সর্প গতরাত্রে গরল উদগীরণ করে সমগ্র ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলেছে আরও। মন বলছে আমার সেই ব্ল্যাক মেইলিংয়ের সঙ্গে মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না এখনো পর্যন্ত কিভাবে সেই যোগাযোগটা ঘটেছে। এবং যতক্ষণ না সেটা আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি, আসল ব্যাপারে আর অগ্রসর হবারও যেন পথ করতে পারছি না। আর সেই কারণেই আপনার ছেলে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আমার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্লিজ, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। ঐভাবে চুপ করে থেকে আমাকে নিরর্থক দেরি করাবেন না।
ক্ষমা করবেন মিঃ রায়। যে লোকটি সম্পর্কে আপনি জানতে চাইছেন সে লোকটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
ফটোর ঐ লোকটি—ওকেও চেনেন না?
না।
কিন্তু আমি যদি বলি রাধেশবাবু, আপনি সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন?
এড়িয়ে যাচ্ছি!
হ্যাঁ। কার ফটো আপনি তা না স্বীকার করলেও আমি জানি ঐ ফটোর খায্যে যে ধরা পড়েছে সে কে, কি তার পরিচয়?
কে? ভীত-বিহ্বল কণ্ঠে অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করে রাধেশ রায় তাকালেন কিরীটীয় মুখের দিকে।
আপনার ছেলে আশোক রায়। শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে কিরীটী শেষ কথাটা উচ্চারণ করল।
এবং কিরীটীর কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাধেশ রায়ের বিষণ্ণ মুখখানি যেন আরও বিষণ্ণ—একেবারে কালো হয়ে গেল মুহূর্তে।