হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা। মৃদুকণ্ঠে কিরীটা বললে, এবং শুধু তাই নয়, সেই হত্যাকারিণী নারী আগে থাকতেই অকুস্থানে উপস্থিত ছিল এও আমার স্থির বিশ্বাস।
কিন্তু কে সে নারী?
আপাতত অন্তরালে থাকলেও খুঁজে তাকে বের করবই।
কিন্তু গতকাল বৈকালী সঙ্ঘে এমন কোনো অপরিচিতা নারীর উপস্থিতির কথাই তো জানা যায়নি কারও জবানবন্দি থেকেই!
তা অবিশ্যি জানা যায়নি সত্যি!
তবে শশী হাজরার স্টেটমেন্টকে যদি নির্ভুল বলে ধরে নেওয়া যায় এবং বাইরের কোনো অপরিচিতা নারী না হয়ে যদি সঙ্ঘেরই কোন মেম্বার নারী হয় তো সে মিত্রা সেনই।
কেন?
কারণ শশী হাজরার স্টেটমেন্ট থেকে জেনেছি মিত্রা সেনই গতরাত্রে প্রথম আসে।
না। সত্যি কথা সে বলেনি। আর সেই জন্যই লাহিড়ীকে বলে এসেছি তাকে এ্যারেস্ট করে তার ওপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবার জন্য। বুঝলাম, কিন্তু তারপর?
এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে অশোক রায়ের সন্ধান করা। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে হয়ত হত্যাকারিণীকে ধরতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না, কারণ সে-ই একমাত্র হত্যাকারিণীকে দেখেছিল।
আর কোনো প্রোগ্রাম নেই?
আছে। দু-জায়গা নিঃশব্দে আজই রাত্রে রেইড করতে হবে।
একটা তো বুঝতে পারছি ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার ও নার্সিং হোম। দ্বিতীয়টি?
তাঁর আবাসগৃহ।
বলিস কি?
হ্যাঁ।
ঐদিনই বিকেলের দিকে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গেল কিরীটীর অনুমান মিথ্যে নয়। তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই মিত্রা সেনের মৃত্যু ঘটেছে-Curara (রারা) বিষের ক্রিয়ায়। এবং তার পাকস্থলীতে যা পাওয়া গিয়েছেসেটার মধ্যে আর যাই থাক অ্যালকোহলের নামগন্ধও নেই। শুধু তাই নয়,যে পেগ গ্লাসটি অকুস্থানে মৃতদেহের সন্নিকটে পাওয়া গিয়েছিল সেটা কেমিকেল অ্যানালিসিস করেও কিছু পাওয়া যায়নি, তবে সিরিঞ্জ অ্যানালিসিস করে Curara বিষ পাওয়া গিয়েছে। এমন কি অ্যালকোহলও না। বিশেষ একটি ব্যাপার যা পুলিস সার্জেন জানিয়েছেন কিরীটীকে সেটা হচ্ছে, মৃতদেহের পৃষ্ঠদেশে একটি নীডল পাংচারের দাগ পাওয়া গিয়েছে, সম্ভবত সেইখানেই ঐ বিষ সিরিঞ্জের সাহায্যে মিত্রা সেনের দেহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
যাক নিঃসন্দেহ হওয়া গেল একটা ব্যাপারে যে, মিত্রা সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাই—আত্মহত্যা নয়।
বিকেলের শেষ রৌদ্রালোকটুকুও যেন যাই-যাই করছিল।
কিরীটীর ঘরের মধ্যে বসে আমি ও কিরীটী ময়নাতদন্ত-রিপোর্টও কেমিকেল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
জংলী এসে ঐসময় ঘরে ঢুকল। বললে ব্যারিস্টার সাহেব রাধেশ রায় এসেছেন, দেখা করতে চান।
কিরীটী বললে, হ্যাঁ, এই ঘরেই নিয়ে আয়।
একটু পরেই প্রৌঢ় ব্যারিস্টার রাধেশ রায় এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাতেই যেটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে আমার চোখে ধরা পড়ল সেটা হচ্ছে, গভীর একটা ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তার ছায়া যেন তাঁর সমগ্র মুখখানির উপর ফুটে উঠেছে।
বসুন মিঃ রায়। কিরীটীই রাধেশ রায়কে আহ্বান জানাল।
রাধেশ রায় সামনের দামী সোফাটার উপরে বসে বারেকমাত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলেন, তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, না মিঃ রায়, তার কোন সন্ধানই করতে পারলাম না। রাত সাড়ে নটার কিছু পরে শুনলাম সে নাকি একবার বাড়িতে এসেছিল। তারপরেই একটা সুটকেস হাতে সে বের হয়ে যায় মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই। চাকরটা জিজ্ঞাসা করেছিল কোথায় সে যাচ্ছে কিন্তু সে কোনো জবাব দেয়নি। বলেনি কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি কি আপনার মনে হয় মিঃ রায়, তারই এ কাজ?
কিরীটী কোনো জবাব দেয় না, চুপ করে থাকে।
রাধেশ রায় আবার বলতে লাগলেন, অশোকের টেম্পারামেণ্ট আমার শুধু ভাল করে জানা বলেই নয়, এ ধরনের ক্রাইম,—আইন-আদালত নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেও বলতে পারি সে এ কাজ করেনি মিঃ রায়। তার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়।
সেটা তো পরের কথা মিঃ রায়, কিরীটী বলে, কিন্তু এভাবে আকস্মিক তাঁর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে করে পুলিসের চোখে কেমন করে নিজেকে তিনি
পরিষ্কার করবেন, যতক্ষণ না তিনি সামনাসামনি এসে দাঁড়াচ্ছেন ও তাদের সমস্ত প্রকার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন!
কিন্তু আমি কি করতে পারি বলুন? আজ পর্যন্ত কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কখনও সে যায়নি। তবু আমি অবিশ্যি পাটনায় আমার ভাইয়ের কাছে, দিল্লীতে তার মেশোর কাছে তার করে দিয়েছি। যথাসম্ভব এখানেও পরিচিত-অপরিচিত সকলের কাছে সন্ধান নিয়েছি।
পরিচিত কোন জায়গায় সে যায়নি। তাছাড়া কাল রাত্রে যে সময় সে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছে, দুরপাল্লার কোনো ট্রেনই তখন আর ছিল না প্রথমত এবং দ্বিতীয়ত ট্রেনে গেলে সেখানে এত তাড়াতাড়ি সে পৌঁছতে পারত না। সে তার নিজের গাড়ি নিয়েই গিয়েছে।
না না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়! তার গাড়ি তো গ্যারেজেই রয়েছে। কিরীটী এবারে প্রত্যুত্তরেমুহূর্তকাল নীরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাধেশ রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, গ্যারেজে আছে সে গাড়ি এবং কাল রাত্রে ছিল না। সে গাড়ি গ্যারেজে ফিরে এসেছে আজ সকাল আটটায়।
কে—কে বলল আপনাকে এ কথা?