হুঁ। তার পর?
তারপর আর কী! যার ফলে গতরাত্রের দুর্ঘটনা ঘটে গেল। নারী তোমার অনুতপ্ত হওয়া উচিত।
কিছুতেই না। বিশ্বাস করি না তোমার কথা। প্রতিবাদ জানায় কৃষ্ণা বৌদি।
বিশ্বাস কর না কর কিন্তু আমি নাচার। যাক সে কথা, গতরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, মোটামুটি তাঁদের একটা গতিবিধির টাইম-টেবল তৈরি করেছি। কাগজটা পড়ে দেখ তো সুব্রত, কোথায়ও ভুল রইল কিনা। বলে এবার কিরীটী আমার দিকে তাকাল।
জানি এসব ব্যাপারে কিরীটীর কোন দিনও ভুল হয় না এবং হতেও দেখিনি। তবুকাগজটা তুলে চোখের সামনে ধরলাম।
দেখলাম কিরীটী গতরাত্রে যারা বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত ছিল তাদের কয়েকজনকে বাদ দিয়ে বাকি সকলকে নিয়ে একটা তাদের গতিবিধির টাইম-টেবিল তৈরি করেছে।
প্রথমেই দেখলাম মিত্রা সেনের নাম। তার পাশে লেখা আছে:
মিত্রা সেন বৈকালী সঙ্ঘে গতরাত্রে এসেছিল, আটটা বাজতে দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে। এবং সম্ভবত সোজা সে নীচের বাগানে চলে যায়। কিন্তু কেন? বাগানে (?) ৭-৫০ মিঃ—পূর্ব পরিকল্পনামত কারও না কারও নির্দেশক্রমে ৭-৪৫ মিঃ বা নিজের ইচ্ছাতেই বা নিজের প্ল্যানমত কারও সঙ্গে দেখা করতে। যদি তাই হয় তো কার সঙ্গে দেখা করতে। সম্ভবত হত্যাকারীই ঐ সময় মিত্রা সেনকে বাগানে আসতে বলেছিল, যাতে করে নির্বিঘ্নে সে তার কাজ হাসিল করতে পারে। হত্যার জন্য বাগানের ঐ স্থানটি সে বেছে নিয়েছিল, কারণ মৃত্যুসময়ে কোনরূপ কাতর শব্দ মিত্রা সেনের কণ্ঠ হতে নির্গত হলেও কারও কানে সেটা পৌঁছবে না এবং নিশ্চিন্তে সে কার্য সমাধা করতে পারবে। সমস্ত কিছু প্যালোচনা করে মনে হয় মিত্রা সেনকে রাত আটটা থেকে আটটা দশের মধ্যেই কোনো এক সময় তীক্ষ্ণ মারাত্মক কোনো বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
অশোক রায়—সকলের জবানবন্দি থেকে বোঝা যাচ্ছে অশোক রায় বৈকালী সঙ্ঘে গতরাত্রে মিত্রা সেনের ঠিক পরে-পরেই এসেছিল রাত আটটা থেকে আটটা দশ মিনিটের মধ্যে কোনো এক সময়ে। সে ৮-১০ মিঃ মধ্যে কিন্তু সোজা বাগানে যায়নি। হলঘরে বোধ হয় ৮-২০ মিঃ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু কেন? কার জন্য অপেক্ষা করছিল? মিত্রা সেনের জন্যই কি? বিশাখা চৌধুরী ৮-৩৫ মিঃ নাগাদ অশোক রায়কে হলঘরে বসে থাকতে দেখেছিল। এবং বৈকালী সঙ্ঘে সেরাত্রে উপস্থিত মেম্বারদের মধ্যে একমাত্র বিশাখা চৌধুরী ব্যতীত অন্য কেউই অশোক রায়কে সে রাত্রে ওখানে দেখেনি। তার কারণ হয়তো অশোক রায় হলঘরে কিছুক্ষণ থেকেই বাগানে চলে যায়,নীচে অন্যান্য মেম্বারদের পৌঁছবার পূর্বেই। বিশাখার স্টেটমেন্ট যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে অশোক রায় বাগানে গিয়েছিল। শশী হাজরার স্টেটমেন্ট থেকে বোঝা (৮-৪৫ মিঃ) যাচ্ছে অশোক রায় রাত পৌনে নটা নাগাদ আবার বৈকালী সঙ্ঘ থেকে চলে যায়। অর্থাৎ ৮-৮১০ মিঃ-এ এসে ৮-৪৫ মিঃ-এ চলে যায়। আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অশোক রায় তাহলে সেখানে ছিল। হলঘরে যদি অশোক রায় কিছুক্ষণ বসে থেকে থাকে, তাহলে ২৫ মিঃ থেকে আধ ঘণ্টা সময় নিশ্চয়ই সে বাগানে ছিল। এখন কথা হচ্ছে, ঐ সময়ের আগে না ঐ সময়ের মধ্যেই মিত্রা সেন নিহত হয়েছে? শুধু তাই নয়, বিশাখা চৌধুরীর স্টেটমেন্ট থেকে আরও একটা ব্যাপার যা আমরা জেনেছি, সেটা হচ্ছে অশোক রায় বৈকালী সঙ্ঘে আসার মিনিট দশেক পরেই বিশাখা চৌধুরী আসেন এবং তারই দু-চার মিনিট বাদে যদি অশোক রায় হলঘর থেকে বের হয়ে বাগানে গিয়ে থাকে, তাহলে সে বাগানে গিয়েছিল সম্ভবত আটটা বেজে দশ মিনিট থেকে আটটা কুড়ি মিনিটের মধ্যেই; এবং বিশাখা তাকে একপ্রকার অনুসরণ করে গিয়েই যদি তার কণ্ঠস্বর ঝোপের পাশ থেকে শুনে থাকে তো তখন সেটা হবে আটটা বেজে পঁচিশ থেকে সাড়ে আটটা। আর তাই যদি হয় তো তাহলে শশী হাজরার স্টেটমেন্ট সত্যি বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ অশোক রায় রাত পৌনে নটা নাগাদ চলে যেতে পারে। এবং সত্যি যদি তাই হয়ে থাকে তো অশোক রায় বাগানে ছিল সে। রাত্রে আটটা কুড়ি মিঃ থেকে আটটা পঁয়ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত। অর্থাৎ মাত্র পনের মিনিট সময়। ব্যাপারটি অত্যন্ত গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। বিশাখা চৌধুরীর কথা থেকে আরও একটা ব্যাপার জানা যাচ্ছে, সেরাত্রে ঐ সময় বাগানে দ্বিতীয় কোন এক নারী ছিল। কে সে? গতরাত্রে যে কজন নারী বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে কি কেউ? কিন্তু বিশাখা চৌধুরী বলেছে ইতিপূর্বে সে কণ্ঠস্বর নাকি সে শোনেনি সঙ্ঘে, তার অপরিচিত। তবে যে-ই থাকুক এটা ঠিক সে আটটার আগেই ঐ রাত্রে সঙ্ঘে এসেছিল। অথচ শশী হাজরার কথা থেকে জানা যায়, মিত্রা সেনই সর্বপ্রথম গতরাত্রে সঙ্ঘে এসেছে। স্বতই এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে, শশী হাজরার ও বিশাখার স্টেটমেন্ট সম্পূর্ণ ঠিক বা correct কিনা! যদি correct হয় তো সে আর কেউ নয়, স্বয়ং (?) এবং সে-ই তাহলে হত্যাকারী কি?
মহারানী সুচরিতা দেবী—নিজে তিনি বলেছেন, তিনি নাকি গতরাত্রে পৌনে নটা অর্থাৎ ৮-৪৫ মিঃ নাগাদ সঙ্ঘে আসেন। তারপর তিনি হলঘরে এসে দেখতে পান ৮-৪৫ মিঃ নাগাদ শ্ৰীমন্ত পাল, সুমিতা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলীকে। হলঘরে তিনি রাত ৯টা পর্যন্ত ছিলেন। সেখান থেকে যান বার-রুমে। সেখানে ৮-৩০ মিঃ–এ দেখতে পান, রঞ্জন রক্ষিত ও বিশাখা চৌধুরীকে। সেখান থেকে ৯-৫মিঃ থেকে ৯-১০মিঃ-এর মধ্যে যান নীচের বাগানে। তাঁর স্টেটমেন্ট যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে নিশ্চয়ই অশোক রায় বাগান ছেড়ে চলে যাবার পর তিনি সেখানে গিয়েছেন। তিনি একটি পদশব্দও শুনেছিলেন নাকি। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। শশী হাজরার স্টেটমেন্ট। তার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী মহারানী গতরাত্রে সঙ্ঘে এসেছেন মিত্রা সেন, অশোক রায় ও বিশাখার ঠিক পরে-পরেই ২৫ মিনিটের মধ্যে। অর্থাৎ রাত ৮-২০ মিঃ থেকে ৮-২২ মিঃ-এরমধ্যে যদি বিশাখা এসে থাকে, তাহলে রাত ৮-২৫ মিঃ থেকে৮-৩০মিঃ–এর মধ্যেই মহারানী গতরাত্রে সঙ্ঘে এসে পৌঁছেছিলেন। এবং তাতে করে পনের মিঃ সময়ের হেরফের হচ্ছে, যে সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটা বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে মহারানী ও মিত্রা সেন এককালে ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন পরস্পর পরস্পরের।