ইনজেকশনের সিরিঞ্জ!
হ্যাঁ, এই যে দেখুন। বলতে বলতে বিশাখা তাঁর হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি কাঁচের রেকর্ড টু সি-সি সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতের উপর তুলে দিলেন।
কিরীটী সিরিঞ্জটা হাতের উপর নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, আমিও তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। টু সি-সি কাঁচের রেকর্ড সিরিঞ্জ একটা এবং ছোট অত্যন্ত সরু একটা হাইপোডারমিক নীডল তখনও তাতে পরানো আছে। তবে নীডলটা একটু বেঁকে গিয়েছে।
ধীরে ধীরে সিরিঞ্জটা দেখা হয়ে গেলে সামনের টেবিলে রেখে কিরীটী পুনরায় বিশাখা চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল। বললে, তারপর বলুন?
সিরিঞ্জটা ব্যাগের মধ্যে পুরে সোজা আর মুহূর্তকাল দেরি না করে উপরে বার-রুমে চলে এলাম। মাথার মধ্যে তখনও আমার যেন কেমন করছে। মীরজুমলার কাছ থেকে একটা স্টিফ পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে হলঘরে ঢুকে সোফার ওপরে বসে পড়লাম। তারই দু-তিন মিনিট বাদে রঞ্জিত রক্ষিত এসে হলঘরে ঢুকল। সেখান থেকে দু-এক মিনিট বাদেই আমরা আবার এসে এই ঘরে ঢুকি।
তাহলে রঞ্জনবাবুর সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে আবার আপনি বাইরে গিয়েছিলেন কেন?
প্রেসিডেন্টকে সংবাদটা দিতে।
দিয়েছিলেন তাঁকে সংবাদটা?
না। কারণ তখনও তিনি তাঁর ঘরে এসে পৌঁছাননি। তাই এ ঘরেই আবার আমি ফিরে আসি। এবং তারই দু-এক মিনিট বাদে মহারানী এসে এই ঘরে ঢোকেন।
একটা কথা বিশাখা দেবী, কিরীটী প্রশ্ন করে, বাগানের সেই পুরুষকণ্ঠটি চিনতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
কার কণ্ঠস্বর সেটা?
অশোকের।
আর নারীকণ্ঠস্বরটি?
বললাম তো, চিনতে পারিনি।
এখানকার মেম্বারদের কারও গলার সঙ্গেই মেলে না?
না।
আর একবার ভাল করে ভেবে বলুন।
না। কারণ এখানকার কারও কণ্ঠস্বরই আমার অপরিচিত নয় মিঃ রায়।
হুঁ। আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন।
বিশাখা চৌধুরী অতঃপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এরপর বাকি সকলকে একের পর এক ডেকে দু-চারটি প্রশ্ন করে কিরীটী তাঁদের ছেড়ে দিতে লাগল।
জবানবন্দি নেবার পালা যখন শেষ হল রাত তখন আড়াইটে বেজে গিয়েছে।
একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, এবারে চল, ওঠা যাক লাহিড়ী। আপাতত উপরের তলার সমস্ত ঘরগুলোতে তালা দিয়ে দুজন কনস্টেবলকে প্রহরায় রেখে দাও। কাল সকালে তোমার থানায় আমি আসছি। পরবর্তী কাজের প্ল্যান সেখানেই আমরা চক-আউট করব।
সেইমতই ব্যবস্থা করে মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে, আমরা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে বের হয়ে এলাম এবং রজত লাহিড়ীকে থানায় নামিয়ে দিয়ে কিরীটীর সঙ্গে তার গাড়িতে তারই বাসায় এসে উঠলাম।
১৯. কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম
কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম রাত্রির শেষ প্রহর উত্তীর্ণ প্রায়।
কিরীটী একটা সোফার উপরে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
বুঝলাম বাকি রাতটুকু কিরীটীর মাথার মধ্যে এখন মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারের জটিল ও দুরূহ চিন্তাটাই পাক খেয়ে খেয়ে ফিরবে। এখন আর ওকে ডাকলে সাড়া মিলবে না। অতএব বড় সোফাটার ওপরে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে চোখ বুজলাম।
সারাটা রাত্রির ক্লান্তি। তাই বোধ হয় চুপ করে সোফার উপরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাও মনে নেই।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল পাশের ঘরের ক্যাজেল ঘড়ির সুমধুর পাঁচটা বাজবার সংকেত-ধ্বনিতে।
চেয়ে দেখি কিরীটী ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে হাত দুটি পশ্চাতে মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করছে যেন আপন মনেই। সামনেই টেবিলের ওপরে দেখি সোজা করে পাতা আছে বৈকালী সঙ্ঘের বাড়িটার আমারই দেওয়া তাকে কাগজে আঁকা প্ল্যানটা ও একটা কাগজ একটা পেপার-ওয়েট দিয়ে চাপা। ভাল করে চেয়ে দেখি সেই কাগজে কতকগুলো নাম ও তার পাশে পাশে সময় বসানো। আর তারই পাশে রয়েছে কিরীটীর প্রিয় মুখখোলা কালো রঙের সেফার্স কলমটা।
বুঝলাম বাকি রাতটুকু কিরীটী চোখের পাতা এক তো করেইনি, এবং মস্তিষ্কের সংখ্যাতীত কোষগুলিতে চিন্তার যে ঘৃণাবর্ত এতক্ষণ ধরে বয়ে গিয়েছে তারও সমাপ্তি এখনও ঘটেনি।
কিরীটীকে ডেকে তার ধ্যান ভাঙাব কি ভাঙাব না ভাবছি, ঐ সময় চায়ের ট্রে হাতে কৃষ্ণা বৌদি এসে ঘরে প্রবেশ করল। খুব ভোরেই স্নান সেরে নিয়েছে বোঝা গেল। সিক্ত কুন্তলরাশি পৃষ্ঠদেশ ব্যেপে রয়েছে। পরিধানে সাদা-কালো চওড়াপাড় তাঁতের শাড়ি ও গায়ে লাল ভেলভেটের ব্লাউজ।
একটু যেন ইচ্ছে করেই সামনের ত্রিপয়ের উপরে চায়ের ট্রে-টা রাখতে রাখতে কৃষ্ণা তার স্বামীকে সম্বোধন করে বলল, মুনিবর! এবারে ধ্যান ভঙ্গ করুন। চা রেডি।
কিরীটী মৃদু হেসে স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকাল, তারপর সোফার উপরে বসে একটি ধূমায়িত চা-ভর্তি কাপ তুলে নিল হাতে নিঃশব্দে।
আমিও একটা কাপ তুলে নিলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, কৃষ্ণা, গতরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে কিছুটা দায়ী কিন্তু তুমিই।
কৃষ্ণা বৌদি তখন সবেমাত্র কিরীটীর পাশেই সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। চকিতে কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, মানে?
মানে আর কী! তোমাদের নারীচরিত্রের পরস্পরের প্রতি সহজাত চিরন্তন ঈর্ষা এবং তুমিই অকস্মাৎ তোমার রূপ-বহ্নি নিয়ে বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত হয়ে সেই ঈর্ষায় ইন্ধন যুগিয়েছিলে অন্য এক নারীর মনে।