ন যযৌ ন তস্থৌ।
কী, জবাব দিন?
বিশাখা চৌধুরীর এতক্ষণের সমস্ত দৃঢ়তা যেন কিরীটীর শেষ প্রশ্নের নির্মম আঘাতে গুঁড়িয়ে একেবারে চুরমার হয়ে গেল।
হঠাৎ দুহাতের মধ্যে মুখ ঢেকে চাপা আর্ত করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন এবারে বিশাখা, বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি-আমি মিত্রার মৃত্যুসম্পর্কে কিছু জানি না, কিছু জানি না।
কিন্তু নিষ্ঠুর কিরীটী।
পূর্ববৎ কঠিন কণ্ঠেই এবারে সে বললে, আপনি তাহলে মিসেস চৌধুরী স্বীকার করছেন এখন যে, আগে আর একবার আপনি আজ রাত্রে একসময় নীচের বাগানে গিয়েছিলেন?
মৃদু ক্ষীণকণ্ঠে এবার প্রত্মর এল ছোট একটিমাত্র শব্দে, হ্যাঁ।
হুঁ। তাহলে এই ঘরে বসে যখন রঞ্জনের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করছিলেন, তার আগেই অর্থাৎ মিঃ রক্ষিতের সঙ্গে দেখা হবার আগেই আপনি একবার বাগানে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি কিছু জানি না। মিত্রার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
সত্যই যদি তাই হয় তো আপনাকে আমি এইটুকুই আশ্বাস দিতে পারি যে আপনার শঙ্কিত হবারও কোন কারণ নেই। তবে আমি যা-যা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি তার মধ্যে যেন কোন কিন্তু রাখবেন না। সত্য জবাবই দেবেন যা জানেন।
বলুন।
আপনি এখানে এসে সোজা তাহলে বাগানেই যান?
একটু ইতস্তত করে বিশাখা জবাব দেন, হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? এসেই সোজা বাগানে গেলেন কেন?
অশোককে যেতে দেখেছিলাম।
তার মানে আপনি তাঁকে ফলো করেছিলেন, তাই কি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন ফলো করছিলেন তাঁকে?
প্রত্যুত্তরে এবারে চুপ করে রইলেন মাথাটা নীচু করে বিশাখা চৌধুরী।
কই, জবাব দিন?
একজন আমাকে অশোক ও মিত্রার ওপরে নজর রাখতে বলেছিল।
হুঁ। কে—সে লোকটি কে?
ক্ষমা করবেন আমাকে মিঃ রায়, আমি তার নাম করতে পারব না।
পারবেন না?
না।
কেন? শুনুন আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এটুকু বিশ্বাস আমাকে করতে পারেন, আপনার কাছ থেকে যে নামটা আমি জেনেছি এ কথা কাউকেই আমি জানাব না। ইচ্ছে করলে আপনি নামটা একটুকরো কাগজে লিখে আমাকে জানাতে পারেন।
ক্ষমা করবেন। তবু পারবো না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাহলে এই আমি বুঝব যে আপনি বলবেন না ইচ্ছে করেই!
বললাম তো আপনাকে আমার কথা। আপনি এখন যা বোঝেন।
মুহূর্তকাল প্রত্যুত্তরে কিরীটী চুপ করে রইল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, নামটা যখন বলবেনই
বলে আপনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ, মিথ্যে পীড়াপীড়ি আর আপনাকে আমি করব না। তবে এটা ঠিকই জানবেন বিশাখা দেবী, এই মুহূর্তে না হলেও, তার নাম জানতে খুব বেশী দেরি আমার হবে না। নাম তার আমি জানবই। যাক সে কথা, আপনি নীচে গিয়ে কী করছিলেন আর কখনই বা ফিরে আসেন?
১৮. আমি যখন নীচের বাগানে যাই
আমি যখন নীচের বাগানে যাই, বলতে লাগলেন বিশাখা চৌধুরী, প্রথমটায় অশোককে কোথায়ও দেখতে পাইনি। তাই ইতস্তত তার সন্ধান করতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষে সেই কামিনী ঝোপের পশ্চাতে গিয়ে উপস্থিত হতেই একটি চাপা সতর্ক নারীকণ্ঠস্বর আমার কানে এল।
নারীকণ্ঠ।
হ্যাঁ।
চিনতে পেরেছিলেন সে নারীকণ্ঠ?
না। কারণ ইতিপূর্বে সে কণ্ঠস্বর কখনও আমি শুনেছি বলে মনে হয় না।
হুঁ। তারপর বলে যান–
শুনতে পেলাম সতর্ক নারীকন্ঠে কে যেন বলছে, এক মুহূর্ত আর এখানে থেকো না। যত তাড়াতাড়ি পার এখান থেকে চলে যাও। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে এবং অন্যান্য মেম্বাররা সব এসে পড়লে তখন মুশকিলে পড়বে। সেই নারীকণ্ঠের প্রত্যুত্তরে শুনলাম কে যেন বললে, কিন্তু হাত-পা আমার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। পারব না, আমি পালাতে পারব না। তার জবাবে সেই পূর্ব নারীকণ্ঠস্বর এবারে বললে, ছি, তুমি না পুরুষমানুষ! এত ভীতু তুমি! এইটুকু সাহস তোমার নেই? যাও শিগগির পালাও এখান থেকে। এরপর পালাবার আর পথ পাবে না। জবাবে এবার পুরুষ বললে, কিন্তু পালালে কি সকলের সন্দেহ আমার ওপরেই পড়বে না? পূর্ব নারী এবারে জবাব দিল, সে পরের কথা পরে। এখনও পালাও। তাছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছকেন, সকলেইতোমার সঙ্গে ওর ইদানীংকার ঘনিষ্ঠতার কথা জানে। এমনিতেও তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না, অমনিতেও না। এই পর্যন্ত বলে বিশাখা চৌধুরী থামলেন।
বলুন, তারপর?
তারপরই একটা দ্রুত পদশব্দ পেলাম, সেটা যেন দূরে চলে গেল ক্রমে ক্রমে।
বলতে বলতে বিশাখা চৌধুরী আবার থামলেন। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
তারপরই আবার কিরীটী বললে, থামলেন কেন, বলুন যা বলছিলেন মিসেস চৌধুরী।
মিসেস চৌধুরী আবার বলতে শুরু করলেন, তারপর কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন স্তব্ধ অনড় হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
এবং কতকটা তারপর ধাতস্ত হবার পর, অতি সন্তর্পণে সেই কামিনী ঝোপের মধ্যে ঢুকে আরও একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম, পিছন ফিরে কে যেন বেঞ্চের ওপর বসে আছে। আর আশেপাশে দ্বিতীয় জনপ্রাণী নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর ঝোপ থেকে সন্তর্পণে বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াতেই, মৃদু চাঁদের আলোয় বেঞ্চের ওপরে উপবিষ্টা মিত্রাকে দেখে যেন চমকে উঠলাম। প্রথমটায় অতটা খেয়াল হয়নি। তারপরই হঠাৎ মনে হল অমন নিঝুম হয়ে মিত্রা বেঞ্চের ওপর বসে আছে কেন? মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে! মনটার মধ্যে কেমন যেন ছাঁত করে উঠল। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। সন্দেহটা এবারে যেন আরও দৃঢ় হল। ভয়টা আরও চেপে বসল। আবার ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! না, তবু কোন সাড়া-শব্দ এল না মিত্রার দিক থেকে। এবারে সত্যি সত্যিই ভয়ে ও আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা যেন কেমন আমার কেঁপে উঠল। এগিয়ে গিয়ে ওর মাথা স্পর্শ করতেই সভয়ে দুপা পিছেয়ে এলাম। সেই মুহূর্তেই আশঙ্কা আমার দৃঢ় হল, মিত্রা মরে গিয়েছে। এবং মারা গেছে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে সঠিকভাবে আরও চার-পাঁচ মিনিট চলে গেল। হাত পা সবঙ্গ তখন আমার কাঁপছে। হঠাৎ এমন সময় ফিরে আসবার জন্য পা বাড়াতেই আমার পায়ে যেন কী ঠেকল। তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিতেই দেখি একটা রেকর্ড সিরিঞ্জ, যা ডাক্তাররা সাধারণত ইনজেকশনের জন্য ব্যবহার করে।