একটা সোফার ওপরে বসে ছিলেন চুপটি করে। আমার যাবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন মিঃ রক্ষিত, I was waiting for you! বললাম, সে কি? তার জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যা থেকেই কেমন যেন একটু dull লাগছে, কিছু ভাল লাগছে না। চলুন একটু ড্রিঙ্ক করা যাক। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। অগত্যা কি আর করি বলুন? একজন ভদ্রমহিলা ড্রিঙ্ক অফার করছেন! দুজনে গিয়ে ঢুকলাম বারে।
তারপর?
তারপর বোধ হয় আধঘণ্টা সেই ঘরেই বসে দুজনে ড্রিঙ্ক করেছি।
আপনারা যে-সময় বারে বসে ড্রিঙ্ক করছিলেন তখন মহারানী সে ঘরে এসেছিলেন?
কে, মহারানী?
হ্যাঁ!
মনে হচ্ছে যেন একবার এসেছিলেন।
কতক্ষণ সেখানে ছিলেন মহারানী?
তা ঠিক মনে নেই।
বিশাখা চৌধুরী আপনার সঙ্গে বার-রুমে কতক্ষণ ছিলেন?
মাঝখানে মনে পড়ছে ড্রিঙ্ক করতে করতে মিনিট পনেরো-কুড়ির জন্য বোধ হয় একবার উঠে যান বার থেকে। তারপর আবার এসে বসেন।
অশোক রায় বা মিত্রা সেনকে সামনাসামনি আপনি আজ রাত্রে একবারও দেখেছেন?
না।
আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন। দয়া করে বিশাখা চৌধুরীকে একবার এ ঘরে যদি পাঠিয়ে দেন!
দিচ্ছি।
রঞ্জন রক্ষিত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
এবারে ঘরে এলেন বিশাখা চৌধুরী।
কিরীটী তাঁকে আহ্বান জানাল, আসুন মিসেস চৌধুরী, বসুন।
নির্দিষ্ট চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বিশাখা চৌধুরী একবার তেরছা ভাবে তীব্ৰদৃষ্টিতে যেন আমার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে সে-সময় আমার প্রতি আর যাই থাক ভালবাসা যে বিন্দুমাত্রও ছিল না সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। এবং কেন জানি না, তাঁর দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টি মিলতেই চোখটা আমি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম।
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে আবার চমকে ফিরে তাকালাম।
কিরীটী বিশাখা চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বলছে, সুব্রতর ওপরে যেন আপনি অবিচার করবেন মিসেস চৌধুরী। আপনাকে আমি এ-কথা হলপ করে বলতে পারি, আপনার প্রতি ওর গত কদিনের ব্যবহারের মধ্যে আর যাই থাক, এতটুকু প্রতারণাও ছিল না। আর ছদ্মবেশে ওর এখানে আসাটা ওর নিজের ইচ্ছায় ঘটেনি, আমরাই পরামর্শ মত!
থাক, ওঁর কথা আর বলবেন না। একটা যেন অতর্কিত থাবা দিয়েই কিরীটীর বক্তব্যটা অর্ধপথে থামিয়ে দিলেন বিশাখা চৌধুরী। তারপরই বললেন, আপনাদের সমস্ত ব্যাপারটা তাহলে pre-arranged! আগে থেকেই সব প্ল্যান করা ছিল!
সত্যি কথা বলতে গেলে, কতকটা হ্যাঁ-ও বটে, আবার কতকটা না-ও বটে। যাক সে কথা। আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেন।
সাধ্য হলে দেব।
অবিশ্যি আপনার সাধ্যের বাইরে কোন প্রশ্ন আমি করব না।
দেখুন মিঃ রায়, আমার ঘণ্টাখানেক ধরে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, যা আপনার জিজ্ঞাস্য আছে একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে আমাকে ছেড়ে দিলে বিশেষ বাধিত হব।
মিসেস চৌধুরী—
প্লিজ। আমাকে বিশাখা চৌধুরী বলে ডাকলেই বাধিত হব।
স্যরি। আচ্ছা আপনি আজ কখন এখানে আসেন?
সোয়া আটটা কি আটটা বিশ হবে।
সোজা আপনি হলঘরে এসেই ঢোকেন তো?
হ্যাঁ।
হলঘরে তখন আর কেউ ছিল?
ছিল, অশোক রায়।
আর মিত্রা সেন?
না, তাকে দেখিনি।
মিত্রা সেনকে আজ একবারও দেখেননি?
না।
মহারানীকে দেখেছিলেন কখন প্রথম?
ঠিক মনে করে বলতে পারছি না। দুঃখিত।
মহারানীকে হলঘরে এসে মিত্রা সেনের মৃত্যুসংবাদ দেবার আগে একবারও দেখেছেন কিনা আপনার মনে পড়ছে না?
না।
আচ্ছা মিঃ রক্ষিতের সঙ্গে এই ঘরে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে আপনি নাকি উঠে বাইরে কোথায় মিনিট পনের-কুড়ির জন্য গিয়েছিলেন, তারপর আবার এই ঘরে ফিরে আসেন, কথাটা কি সত্যি?
Funny! কে আপনাকে এ কথা বলেছে মিঃ রায়? আমি এ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর আর তো এ ঘরে ফিরে আসিনি? আমি এ ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে হলঘরেই ছিলাম।
এ ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার আপনি এ ঘরে ফিরে আসেননি তাহলে?
Certainly not!
কিন্তু যদি বলি আজ রাত্রে মিত্রা সেনের মৃতদেহ বাগানের মধ্যে আবিষ্কৃত হবার পূর্বেই একবার আপনি কোন এক সময় নিচের বাগানে গিয়েছিলেন?
তাহলে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হব যে, আপনার অনুমানটা বা জানাটা সম্পূর্ণ ভুল!
বিশাখা চৌধুরীর সদম্ভ উক্তির সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মুখখানা যে সহসা কঠিন হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে চাপা মৃদু কণ্ঠে এবারে সে বলে, ভুল!
হ্যাঁ।
তারপর কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই যেন এগিয়ে গেল দুপা উপবিষ্টা বিশাখা চৌধুরীর দিকে এবং হাত বাড়িয়ে তাঁর মাথার কেশ থেকে ছোট পাতা সমেত কামিনীগাছের একটা ভাঙা শাখা টেনে বের করে বলল, মিত্রা সেন যেখানে বেঞ্চের ওপর মৃত অবস্থায় ছিলেন তার পিছন দিকে একটা কামিনী গাছের বোপ আছে, আপনার নিশ্চয়ই অজানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর আপনারা যখন সকলে মিলে বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, সে-সময় কেমন করে এই বস্তুটি আপনার চুলের সঙ্গে আটকে থাকতে পারে বলতে পারেন। যদি সত্যি আপনার কথাই মেনে নেওয়া যায় যে, সেই সময়ই প্রথম আপনি আজ নীচের বাগানে গিয়েছিলেন।
বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মুখের কোথায়ও যেন বিন্দুমাত্র রক্ত আর নেই। সমস্ত রক্ত যেন তাঁর মুখ থেকে কে ব্লটিং পেপারে শুষে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, কিরীটীর মুখের দিকে স্থাপিত তাঁর দু-চোখের বোবাদৃষ্টির মধ্যে সেই মুহূর্তে যে অসহায় করুণ একটা ভাব ফুটে উঠেছিল তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, তিনি যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছেন যেন।