এত পসার ও খ্যাতি লোকটার তবু নাকি ব্যবহারে তাঁর এতটুকু চাল বা অহঙ্কার নেই। পূর্বে যারা তাঁকে চিনত, তারা বলে, ভুজঙ্গ ডাক্তার আগের মতোই ঠিক আছে। কোন বদল হয়নি।
তাঁর সম্পর্কে গুজবের অন্ত নেই। বিশেষ করে তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স সম্পর্কে। এখনও কিন্তু তিনি নিজের বাড়িও একটা করেননি।
০২. ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে
ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে পূর্বে সাক্ষাৎ-পরিচয় না থাকলেও জনরব ও জনশ্রুতিতে লোকটি আমাদের একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। সাক্ষাৎভাবে পরিচয়-সৌভাগ্য হল মাত্র আজই সকালে।
রবিবার। হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ। হাসপাতালে সকালেই বেরুবার তাগাদা নেই। তাছাড়া রবিবার চেম্বারেও সকালে স্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যতীত তিনি রোগী দেখেন না। তাই ভুজঙ্গ ডাক্তার সকাল সাড়ে আটটায় কিরীটীর সঙ্গে সাক্ষাতের টাইম দিয়েছিলেন। সাক্ষাতের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল সাড়ে আটটায় ঠিক।
আমরা পাঁচ মিনিট আগেই ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছেছিলাম। বেয়ারার হাতে পূর্বেই কিরীটীর কার্ড প্রেরিত হয়েছিল। ওয়েটিং রুমটি চমৎকার ভাবে সাজানো। একেবারে খাস ইউরোপীয়ান স্টাইলে।
মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট। সোফা কাউচ। গোলাকার একটি টেবিল ঘরের মধ্যস্থলে। চকচকে সব ফার্নিচারেরই চোখ ঝলসানো পালিশ। সাদা নিরাবরণ দুধধবল চুনকাম করা দেওয়ালে কিছু ফ্রেসকোর সূক্ষ্ম কাজ। কোন ছবি বা ক্যালেণ্ডার নেই। এক কোণে একটি বিরাট ঘড়ি স্ট্যাণ্ডের উপর বসানো।
ঘরের জানলা ও দরজার পর্দায় ফিকে নীল সূক্ষ্ম বিলিতি নেটের সব পদা ঝোলানো।
ঢং করে সময়-সংকেত ঘরের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে কোথায় যেন অদৃশ্য ইলেকট্রিক সাংকেতিক একটা শব্দ শোনা গেল, কঁ কঁ…. সঙ্গে সঙ্গে বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকে বললে, আসুন।
বেয়ারার পিছনে পিছনে করিডোর পার হয়ে আমরা এসে সম্পূর্ণ-বন্ধ একটি কপাটের সামনে দাঁড়ালাম।
কপটটা ঠেলতেই লিং অ্যাকশানে সরে গেল, বেয়ারা বললে, ভিতরে যান।
প্রথমে কিরীটী ও তার পশ্চাতে আমি একটি প্রশস্ত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ওয়েটিং রুমটির মতই এই ঘরটিও অনুরূপ রুচিসম্মতভাবে সাজানো-গোছানো। দিনের বেলাতেও জানালায় ভারী মোটা ফিকেনীল স্ক্রিন টানা।
চার-পাঁচটা বড় বড় ডোমের অন্তরালে অদৃশ্য শক্তিশালী বিদ্যুৎ-বাতির আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে, বাইরের সূর্যালোক ভিতরে না আসা সত্ত্বেও।
ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের অদ্ভুত সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠের আহ্বান কানে এল, আসুন। Be seated please Mr. Roy! এক মিনিট।
কণ্ঠস্বরে সামনের দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল সাদা ধবধবে অ্যাপ্রন গায়ে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অর দেওয়ালের কাছে ঘূর্ণমান একটা লিকুইড সোপর কাঁচের আধার থেকে সোপ নিয়ে ওয়াশিং বেসিনের ট্যাপে হাত ধুচ্ছেন।
ঘরের ঠিক মধ্যখানে এক একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিল। পুরু কাঁচের প্লেট তার উপরে। একটি ডোমে ঢাকা ফ্লেকসিবিল টেবিল-ল্যাম্প।
টেবিলের উপরে বিশেষ কিছুই নেই। একটি স্টেথোসকোপ, একটি প্রেসক্রিপসন প্যাড, এটি মুখখোলা পার্কার ফিফটিওয়ান, একটি কাঁচের গোলাকার পেপারওয়েট। একটি ঝিনুকের সুদৃশ্য অ্যাসট্রে। একটি ৯৯৯য়ের সিগারেট টিন ও একটি ম্যাচ।
বড় টেবিলের পাশেই কাঁচের প্লেট বসানো একটি স্ট্যাণ্ডের উপরে সাদা এনামেলের ট্রেতে কিছু ডাক্তারী পরীক্ষার আবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি। তারই পাশে বসবার ঘোরানো একটি গদি-আঁটা গোল টুল। এবং তারই সামনে ডাক্তারের বসবার জন্যই বোধ হয় গদি আঁটা একটি রিভলবিং চেয়ার। টেবিলের অন্যদিকে গদি আটা সুদৃশ্য আরও দুটি চেয়ারও নজরে পড়ল। কনসালটিংয়ের সময় ঐ চেয়ারই বোধ হয় নির্দিষ্ট রোগী ও তার সঙ্গের অ্যাটেনডেন্টের জন্য। এক পাশে অন্য একটি দরজা দেখা যাচ্ছে, ভিতরে বোধ হয় সংলগ্ন আর একটি পরীক্ষা-ঘর আছে। ঘরে মেঝেতে ফিকে সবুজ বর্ণের রবার-কার্পেট বিছানো।
নিঃশব্দ পায়ে আমরা দুজনে এগিয়ে গিয়ে সেই দুটি চেয়ারই অধিকার করে বসলাম। ডাক্তার হাত ধুতে লাগলেন।
ওয়েটিং রুমের মত কনসালটিং রুমের দেওয়ালও সম্পূর্ণ সাদা এবং দেওয়ালে কোন ছবি বা ক্যালেণ্ডার নেই। একটি মাত্র গোলাকার ইলেকট্রিক ক্লক ছাড়া। মিনিটে মিনিটে বড় কাঁটাটা সরে যাচ্ছে এক এক ঘর।
হাতধোয়া শেষ করে ডাক্তার আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। দুই ওষ্ঠের বন্ধনীতে আলগাভাবে ধরা অর্ধদগ্ধ একটি সিগারেট। টাওয়েলের সাহায্যে হাতটা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, সাক্ষাৎ পরিচয় আপনার সঙ্গে না থাকলেও আপনার নামটা আমার অপরিচিত নয় মিঃ রায়। বলতে বলতে টাওয়েলটা স্ট্যান্ডের উপরে রেখে রিভলবিং চেয়ারটার উপরে এসে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
তাকিয়েছিলাম আমি ডাক্তারের মুখের দিকেই। হাসির সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন বিশ্রী লাগল। চোখটা ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।
ডাক্তার বলছিলেন তখন, বুঝতেই পারেন, ডাক্তার মানুষ, বড্ড un-social, নচেৎ আপনার সঙ্গে আলাপ এক-আধবার হওয়ার নিশ্চয়ই সুযোগ ঘটত।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে এবারে জবাব দিল, সাক্ষাৎ-পরিচয়ের সৌভাগ্য না হলেও আপনিও আমার একেবারে অপরিচিত নন ডক্টর চৌধুরী।