.
নীচের রিসেপশন রুমের বেয়ারা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
কি নাম তোমার?
আজ্ঞে স্যার, শশী হাজরা।
তোমার ডিউটি নীচের রিসেপশন ঘরে বুঝি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ স্যার।
কতক্ষণ থাকতে হয় তোমার সেখানে?
রাত আটটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
প্রতি রাত্রেই তুমি থাক?
হ্যাঁ।
তোমার কোনরকম অসুখ-বিসুখ করলে?
আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি স্যার।
এখানে তুমি কতদিন কাজ করছ শশী?
সাত বছর স্যার।
সাত বছর! মিঃ চক্রবর্তী শুনেছি এখানকার প্রেসিডেন্ট গত সাত বছর ধরে। তুমি আর তিনি কি তাহলে একসঙ্গেই এখানে আস? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, কতকটা তাই বটে। প্রেসিডেন্টই আমাকে আর মীরজুমলাকে এখানে কাজ দেন স্যার। তোমাদের দুজনকে বুঝি তিনি আগে থাকতেই চিনতেন?
হঠাৎ এবারে কিরীটীর প্রশ্নে শশী যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললে, আজ্ঞে না, ঠিক তা নয়, এখানকার দারোয়ানের মুখে এখানে লোকের প্রয়োজন শুনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করি, তিনি তখন কাজ দেন।
দেখা করার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার এখানে কাজ হয়ে গেল, সঙ্গে কারও জোরালো সার্টিফিকেট ছিল বুঝি তোমার শশী?
সাটিফিকেট?
হ্যাঁ?
কই না!
তবে এমন একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠানে চাওয়া মাত্রই কাজ পেয়ে গেলে? আগে কোথায় কাজ করতে?
আগে আর কোথায়ও কখনও কাজ করিনি।
এইখানেই প্রথম?
হ্যাঁ।
ভাগ্যবান তুমি শশী! এই চাকরির অভাবের বাজারে চাওয়া মাত্রই কাজ পেয়ে গেলে! তা মাইনে কত পাও?
ষাট টাকা।
তুমি দেখছি ডবল ভাগ্যবান! তা থাক কোথায়? কোথাকার লোক তুমি? এর আগে কলকাতাতেই বরাবর ছিলে নাকি?
পর পর কিরীটীর প্রশ্নগুলো যেন শশী হাজরাকে বেশ একটু বিচলিত করে তোলে। কিন্তু লোকটা দেখলাম বেশ চালাক-চতুর। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ভাগ্যবান যদি বলেন তো স্যার, তাও আপনাদেরই শ্রীচরণেরই দয়া। আপনারা শ্রীচরণে আশ্রয় না দিলে কে আমাদের মত গরিব-দুঃখীকে দেখবে বলুন? প্রেসিডেন্ট সাহেব এখানকার বিচক্ষণ ও মহৎ। মানুষ চেনেন তিনি। চাকরির আগে অবিশ্যি থাকতাম বেলেঘাটায় এক বস্তিতে। তারপর এখানে চাকরি হবার মাস দুই পর থেকে এখানেই থাকবার হুকুম পেয়েছি। এখন এখানেই থাকি। বাড়ি আমার মেদিনীপুর জেলায়, পাঁশকুড়া থানা।
হুঁ। আর মীরজুমলা? সেও এখানেই থাকে?
হ্যাঁ। নীচের ঘরে আমি, দারোয়ান, মীলজুমলা—তিনজনে থাকি।
আচ্ছা শশী, বলতে পার আজ কে কে এখানে এসেছিলেন রাত্রে? এবং পর পর কে কখন এসেছেন?
ঠিক তো স্মরণ নেই স্যার! কে কখন এসেছেন—
যতটা পার স্মরণ করেই বল।
শশী হাজরা অতঃপর মনে মনে কী যেন ভেব নিল। তারপর মৃদুকণ্ঠে থেমে থেমে বলতে শুরু বলতে–
সর্বপ্রথমে আসেন মিস সেন। তারপর—
মানে মিত্রা সেন?
হ্যাঁ।
তারপর?
তারপর বিশাখা চৌধুরী, তারপর বোধ হয় অশোকবাবু। তারপর—
অশোকবাবু তাহলে আজ রাত্রেও এসেছিলেন? বাধা দিল কিরীটী।
হ্যাঁ স্যার।
কখন তিনি আবার তাহলে চলে গিয়েছেন?
তা রাত তখন পৌনে নটা হবে বোধ হয়।
আচ্ছা মনে করে বলতে পার তিনি কখন এসেছিলেন আজ এখানে?
রাত আটটার দু-পাঁচ মিনিট পরেই হবে স্যার।
কি করে বুঝলে?
তারই কিছু আগে নীচের ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত আটটা বাজতে শুনেছিলাম। তাতেই মনে আছে স্যার সময়টা।
হ্যাঁ, আর মিত্রা সেন?
তার মিনিট দশেক পরে।
আর বিশাখা চৌধুরী?
তার দু-পাঁচ মিনিট পরেই।
মহারানী কখন এসেছেন?
ঐ বিশাখা চৌধুরীর কয়েক মিনিট বাদেই স্যার।
তোমাদের প্রেসিডেন্ট?
রাত দশটায়।
সাধারণত রাত কটা নাগাদ তোমাদের প্রেসিডেন্ট এখানে আসেন শশী?
তার কোন ঠিক নেই। তবে পৌনে দশটা থেকে দশটার মধ্যেই আসেন বরাবর দেখছি।
আচ্ছা শশী, বলতে পার, এখানে যাঁরা আসেন সাধারণত তাঁদের ভেতরে ঢুকতে হলে কি ওপরের হলঘরের মধ্যে দিয়েই ঢুকতে হয়?
না। তা কেন হবে? হলঘরের দরজার মুখেই ডান দিকে যে ঘরটা আছে, তার মধ্যে দিয়েও ঢুকে প্যাসেজ দিয়ে আর একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে চার নম্বর দরজা দিয়েও তো ইচ্ছে করলে হলঘরে ঢুকতে পারা যায় স্যার। প্রেসিডেন্টের ঘর থেকেও তিন নম্বর বা চার নম্বর দরজা দিয়েও হলঘরে ঢোকা যায়। আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব তো কখনও হলঘর দিয়ে ঢোকেনই না স্যার। ঐ প্যাসেজ দিয়ে সোজা তাঁর ঘরে চলে যান আবার সেই রাস্তা দিয়েই বের হয়ে আসেন।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার, মীরজুমলাকে এবারে পাঠিয়ে দাও।
সেলাম জানিয়ে শশী বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
শশী ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই পকেট থেকে কাগজের উপরে আঁকা ঐ বাড়িটার একটা নকশা বের করে আমি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, এই নে কিরীটী, আমি এ বাড়ির একটা নকশা গতকাল বসে বসে এঁকেছিলাম। এ বাড়ির সব কিছু সন্ধান এর মধ্যেই পাবি।
কিরীটী আমার হাত থেকে নকশাটা নিয়ে আলোর সামনে মেলে ধরল। থানার ও. সি. আলোর সামনে মেলে ধরল। থানার। রজত লাহিড়ীও নকশার উপর ঝুঁকে পড়লেন।
পদশব্দ শোনা গেল আবার দরজার ওপাশে। মকশার উপর চোখ রেখেই কিরীটী বলে, মীলজুমলাকে আসতে বল সুব্রত ঘরে।
আমিই মীরজুমলাকে ঘরে ডাকলাম।
১৬. মীরজুমলা
তোমার নাম মীরজুমলা? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
জী
দেশ কোথায়?
ঢাকা জিলা।
বাঙালী তুমি?
হ্যাঁ।
তুমি আর শশী এখানে সাত বছর কাজ করছ, তাই না?
শশী বলেছে বুঝি?
যেই বলুক, কথাটা সত্যি কিনা?