তার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে। সাড়া দেবার জন্য গলা-খাঁকারি দিলাম। কিন্তু অপরপক্ষ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। এবারে কেমন একটু যেন বিস্মিতই হলাম। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিস সেন! কোনো সাড়া নেই তবু। এই পর্যন্ত বলে মহারানী থামলেন।
বলুন, তারপর? আবার কিরীটী তাগিদ দিল।
আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে এবারে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন্! তবু সাড়া নেই। যেমন তিনি বুকের কাছে মাথা ঝুলিয়ে বসেছিলেন তেমনই রইলেন।
ঘুমিয়ে পড়েননি তোভেবে হাত বাড়িয়ে তাঁর গায়ে হাত দিয়ে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন! না, তবু সাড়া নেই। এবারে কেন জানি না হঠাৎ গা-টা যেন আমার কেমন ছমছম করে উঠল। চারদিকে একবার তাকালাম। আশেপাশে কেউ নেই। কেবল চাঁদের আলো ও অন্ধকারে আবছা একটা আলোছায়ার থমথমানি। ঠিক সেই মুহূর্তে কী আমার মনে হয়েছিল জানি না, পরক্ষণেই আঙুল দিয়ে তার কপাল স্পর্শ করতেই যেন মনে হল, কোনও মানুষের জীবন্ত শরীর নয়, অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রাণহীন কি একটা স্পর্শ লাগল আমার আঙুলের ডগায়। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল আমার। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নিজের অজ্ঞাতেই আবার শিউরে উঠে মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠে বললেন, that uncanny sensation! I will never forget and I cant explain you even what it was!
হঠাৎ চুপ করে গেলেন মহারানী।
সকলেই আমরা মহারানীর ভয়-বিহ্বল মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। স্তব্ধ ঘরটার মধ্যে কেবল ওয়াল-ক্লকের পেণ্ডুলামটার একঘেয়ে টকটক শব্দ হয়ে চলেছে।
কয়েকটি মুহূর্ত স্তব্ধতার মধ্যেই কেটে গেল।
বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তারপর আবার মহারানী বলতে শুরু করলেন, এবং যখন সম্বিৎ ফিরে এল হঠাৎ যেন মনে হল, মিস সেন বেঁচে নেই। সে মৃত। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্ধশ্বাসে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে আসি। সোজা একেবারে হলঘরে এসে ঢুকি। Now I find. she is really dead! সত্যিই সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু এখনও যেন আমি ভাবতে পারছি না মিঃ রায়, কী করে এ দুর্ঘটনাটা ঘটল আর কেনই বা ঘটল? কেন সে আত্মহত্যা করল?
কিন্তু আত্মহত্যা তো নয় মহারানী! বললে কিরীটী।
চমকে তাকালেন মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে। প্রশ্ন করলেন, আত্মহত্যা নয়? তবে—
নিষ্ঠুর হত্যা। Cold-blooded murder!
মার্ডার! She has been murdered! এ আপনি কী বলছেন, মিঃ রায়! How impossible!
আমার ধারণা আমি ঠিকই বলেছি। মিস্ সেনকে হত্যাই করা হয়েছে মহারানী।
কিন্তু কে তাকে হত্যা করবে, আর কেনই বা করবে? She was so nice! So Charming! সকলেই তাকে ভালবাসত।
আপনি হয়ত জানে না মহারানী, বুকভরা ভালবাসার অমৃত থেকেই অনেক সময় বিষের ফেনা গেঁজিয়ে ওঠে। তাছাড়া এখানে আপনারা যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁদের কার মনে কোন্ গোপন ভালবাসা, ব্যর্থতা, ক্রোধ, হিংসা বা বিদ্বেষ জমা হয়ে আছে তা জানবেন কি করে?
কিন্তু–
না, মহারানী! তা যদি না হত তো এমনি নিষ্ঠুর হত্যা তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে প্রকাশ পেত না। কিন্তু থাক সে কথা। আজ এই মুহূর্তে না হলেও, জানতে আমরা পারবই। আর একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করব।
বলুন।
জানতেন কি, অশোক রায় ও মিত্রা সেনের মধ্যে বিবাহের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গিয়েছিল?
Absured, impossible! বিশ্বাস করি না আমি।
সত্যিই হয়ে গিয়েছিল, রেজেস্ট্রি অফিসে পদের নাম পর্যন্ত রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছিল।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। একবর্ণও মিথ্যে নয়, যা আমি বললাম।
আশ্চর্য তো!
মাত্র একটি শব্দই নির্গত হল মহারাণীর কণ্ঠ হতে।
মহারানীর চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত আশ্চর্য শব্দটি ও সেই মুহূর্তের তাঁর চোখ ও মুখের চেহারা স্পষ্টই যেন আমার কাছে ব্যক্ত করল—বিস্ময়ই নয়, আরও একটা কিছু সেই সঙ্গে। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী যেন বুঝে উঠতে পারলাম না।
পরমুহূর্তে আবার কিরীটী প্রশ্ন করল মহারানীকে, তা এতে আশ্চর্য হবার কি আছেমহারানী? এত দিন পরে হয়ত মিস্ সেন তাঁর জীবনের যোগ্য সাথী খুঁজে পেয়েছিলেন, তাই তাঁরা বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন।
আজ যখন মিত্রা বেঁচে নেই তখন আসল কথাটা বলতে আর আমার দ্বিধা নেই মিঃ রায়। মিত্রাকে আমি দীর্ঘদিন থেকে জানি। এক সময় she was my classmate! সেই থেকে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার সুযোগ হয়। পুরুষ জাতটার প্রতিই she had a peculiar complex
কি রকম?
সে বলতো পুরুষের জন্মই নাকি মেয়েদের মন যোগানোর জন্য এবং যে কোনো পুরুষের চোখের সামনেই দেহের প্রলোম তুলে তাকে নাচানো যেতে পারে। আর সেইটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র নিষ্ঠুরতম খেলা বা সেই নিষ্ঠুরতম খেলার মধ্যে দিয়ে সে আনন্দলাভ করাটাই একমাত্র নেশা! স্ত্রীলোক হয়ে জন্মেও সে যে কত বড় হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল, আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম। আর সেই নিষ্ঠুর খেলায় শুধু অশোক রায় কেন, তার আগে অসীম বোস, সুধীর মিত্র প্রভৃতি কতজনার যে সে সর্বনাশ করেছে সে তো আমার অজানা নয়!
কথাগুলো বলতে বলতে একটা অবিমিশ্র ঘৃণা যেন মহারানীর কণ্ঠ হতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। আমরা সকলেই নিঃশব্দে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। কয়েকটা মুহূর্ত থেমে আবার মহারানী বলতে লাগলেন, তাই বলছিলাম অশোক রায় মিত্রার মৃত্যুর কথা জানতে পারলে, আজ দুঃখ পেলেও, পরে একদিন বুঝতে পারবে মিত্রার মৃত্যু was a blessing to him in disguise!
১৫. মহারানীর জবানবন্দির পর
মহারানীর জবানবন্দির পর ঘরে এসে ঢুকলেন শ্ৰীমন্ত পাল কিরীটীরই নির্দেশে।