কিন্তু একটা কথা যে আপনার আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করে আবার।
বলুন?
এখানকার ডিসিপ্লিনের ব্যাপারটা যখন এঁরা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন
তা দিয়েছেন বটে। তবে সেটা একান্ত অফিস-সংক্রান্তই। কারোর ব্যক্তিগত গণ্ডি পর্যন্ত সেটা যেমন কখনও এক্রোচ করিনি এবং করার আমি প্রয়োজনও বোধ করিনি কোনদিন। এখানকার যারা মেম্বার, তারা সকলেই সম্ভ্রান্তবংশীয়, সমাজ বা সোসাইটিতে তাদের যথেষ্ট পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে। ভল-মন্দ বোঝবার তাদের নিজেদের বয়সও হয়েছে।
কিন্তু এ কথাটা কি সত্যি নয় মিঃ চক্রবর্তী যে, এ সঙ্ঘ গড়বার পিছনে নিশ্চয়ই কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে? প্রশ্ন করে আবার লাহিড়ীই।
উদ্দেশ্য আর কি! দশজনের কোন একটা জায়গায় মেলামেশার মধ্যে দিয়ে খানিকটা নির্দোষ আনন্দ লাভ করা!
শুধুমাত্র নিদোষ খানিকটা আনন্দই? আর কিছু নয়? জিজ্ঞাসা করে কিরীটী।
না। আমি যতদূর জানি তাই।
কিন্তু এখানে ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, ফ্ল্যাশও চলে শুনেছি? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
তা চলে একটু-আধটু।
একটু আধটু নয়। পুরোপুরি নাইট ক্লাবই এটা একটা।
নাইট ক্লাব বলে আপনি ঠিক কি মীন করতে চাইছেন জানি না মিঃ রায়, তবে আপনাদের তথাকথিত আইনভঙ্গের কোন ব্যাপারই এখানে ঘটে না। সেটা ভাল করে খোঁজ নিলেই একটু জানতে পারবেন। বলে আবার একটা কাশির ধমক যেন সামলে নিলেন মিঃ চক্রবর্তী।
নাইট ক্লাব বলতে ঠিক যা মীন করে, আমিও ঠিক তাই মীন করেছি মিঃ চক্রবর্তী। কিন্তু যাক সে কথা। আপনার এখানকার কাজটা কি পেইড? না অনারারী?
সম্পূর্ণ অনারারী, মিঃ রায়।
তাহলে এ সঙ্ঘের ওপর আপনারও একটা অন্তরের টান আছে বলুন! নইলে প্রতি রাত্রে এই বয়সে, বিশেষ করে আপনার এ নানাবিধ বোগজর্জর দেহ নিয়ে সাড়ে নটা থেকে রাত বারোটা একটা পর্যন্ত এখানে চেয়ারে বসে থাকেন কি করে?
আর একটা কাশির দমক সামলে নিয়ে মিঃ চক্রবর্তী বললেন, তা যে একেবারে নেই, বললে মিথ্যাই বলা হবে মিঃ রায়। কথাটা তাহলে খুলেই বলি। বিয়ে-থা করিনি, বাপ-পিতামহ জমিদারি করে বেশ কিছু অর্থও রেখে গিয়েছিল, একমাত্র বংশধর তাদের আমি। চিরকাল হেসে খেলে স্ফুর্তি করেই কাটিয়ে বছর সাতেক আগে গাঁয়ের বসবাস তুলে দিয়ে কলকাতায় যখন চলে আসি, সময় কাটছিল না, সেই সময়ই এখানকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সুখময়বাবুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এখানে এসে ঢুকি।
হুঁ, তারপর?
পরে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হওয়ায় এরা সকলে মিলে আমাকে ধরে বসল, প্রেসিডেন্টের পদটা আমাকে নেবার জন্য। ভাবলাম মন্দ কি, এমনিতেই তো এ বয়সে ঘুম কম। সময়টা কাটানো যাবে।
তা বেশ করেছেন। সময় ভালোই কাটাচ্ছেন, কি বলেন? প্রশ্ন করলেন আবার রজত লাহিড়ী।
আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ যদি শেষ হয়ে থাকে–
হ্যাঁ, আপাতত আপনি যেতে পারেন। বললে কিরীটী। কেবল একটা প্রশ্ন, সামনের শনিবার অশোক রায়ের সঙ্গে মিত্রা দেবীর বিবাহের সব স্থির হয়েছিল, জানেন কিছু?
না।
.
এবার এলেন মহারানী সুচরিতা দেবী।
বসুন মহারানী ঐ চেয়ারটায়। রজত লাহিড়ী বললেন।
মহারানী চেয়ারে বসবার পর কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনিই প্রথমে মিত্রা সেনের মৃতদেহ দেখতে পান, তাই না?
আমিই প্রথমে সকলকে হলঘরে এসে জানাই।
লক্ষ্য করলাম প্রশ্নটার জবাব একটু ঘুরিয়ে দিলেন মহারানী।
আজ রাত্রে কখন আপনি এখানে আসেন?
রাত পৌনে নটা হবে বোধ হয় তখন।
আপনি যখন হলঘরে এসে ঢোকেন আর কেউ সে ঘরে ছিলেন?
ছিল।
মনে আছে আপনার, কে কে ছিলেন তখন হলঘরে?
হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল, সুমিতা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক আর সুপ্রিয় গাঙ্গুলী।
আর কেউ ছিল না?
না।
তারপর আপনি হলঘর থেকে কখন বেরিয়ে যান?
মিনিট পনেরো বাদেই। মানে সওয়া নটা নাগাদ বলুন?
ঐ রকমই হবে।
কোথায় যান হলঘর থেকে বের হয়ে?
বার-রুমে।
সেখানে কতক্ষণ ছিলেন?
মিনিট পনের-কুড়ি হবে। মাথাটা সন্ধ্যা থেকেই ধরেছিল, তাই বার-রুমে গিয়ে একটা রাম ও লাইম খেয়েও যখন মাথাটা ছাড়ল না, বাগানে গিয়েছিলাম একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে।
সঙ্গে সে সময় আপনার কেউ ছিল, না একাই গিয়েছিলেন বাগানে?
একাই গিয়েছিলাম।
বার-রুমে যখন আপনি যান, সে সময় সে ঘরে আর কেউ ছিল?
ছিল।
কে?
রঞ্জিত রক্ষিত আর বিশাখা চৌধুরী।
আর কেউ ছিল না?
না।
অশোকরায় বামিত্রাসেনকে তাহলে আপনি হলঘর বাবার-রুমেকোথাও আজ দেখেননি?
না।
বেশ। তারপর বলুন বাগানে গিয়ে আপনি কি করলেন?
বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ এলোমোলো ভাবে ঘুরে বেড়াই, তারপর দক্ষিণ দিকের ঐ কুঞ্জের কাছাকাছি যেতেই মনে হল–
কি, থামলেন কেন? বলুন? কিরীটী তাড়া দিল মহারানীকে।
মনে হল একটা যেন দ্রুত পদশব্দ বাঁ দিককার বড় ঝোপটা বরাবর মিলিয়ে গেল। কিন্তু সে সময় অতটা খেয়াল হয়নি।
কেন?
কারণ বাগানে তো অনেকেই যেত, তাই ভেবেছিলাম হয়ত কেউ—
তারপর বলুন।
আর একটু এগুতেই আবছা চাঁদের আলোয় হঠাৎ নজরে পড়ল, বেঞ্চের ওপর একাকী বসে আছে যেন কে! প্রথমটায় চিনতে পারিনি। তাছাড়া যে বসেছিল তার সামনাসামনি যাবারও আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না। ফিরে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন মনটার মধ্যে কিছু বোধ হওয়ায় যে বসেছিল তার বসবার বিশেষ ভঙ্গীটি দেখে এগিয়ে গেলাম আরও একটু কাছে। এবারে মনের কিছুটা যেন আরও স্পষ্ট হল। যে বসে আছে, তার মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে যেন কি এক অসহায় ভঙ্গীতে। কাছে এগিয়ে যেতে এবারে চিনতে পেরেছিলাম, সে আর কেউ নয়, মিত্রা সেন। কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম