এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে যেন নির্বাক দর্শকের মতই একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিঃ লাহিড়ী। একটি কথা বা একটি মন্তব্যও করেননি। কিরীটীর প্রশ্নোত্তরে মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, রাত অনেক হয়েছে, প্রায় সাড়ে এগারোটা।
চল্ চল্ সুব্রত। হলঘরে একবার যাওয়া যাক।
১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে
হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখেই কানে এসেছিল বহু কণ্ঠের মিশ্রিত চাপা একটি গুঞ্জন। আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেইযেন সেটা সহসা থেমে গেল। ভাষাহীন একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন সহসা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠল।
কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও হলঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম।
বুঝতে পারলাম, ইতিমধ্যেই বাকি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যেও দুঃসংবাদটা প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। কারণ হলঘরের মধ্যে সকলেই উপস্থিত ছিলেন। দেখতে পেলাম না কেবল সকলের মধ্যে বিশেষ দুটি প্রাণীকে। একজন হচ্ছেন বৈকালী সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তী, দ্বিতীয় অশোক রায়। আরও একটা ব্যাপার যা আমার দৃষ্টিকে এড়ায় নি, সেটা হচ্ছে ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীর চোখেমুখেই যেন একটা চাপা ভয় ও আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেরই মনের উদ্বেগ যেন প্রত্যেকের নীরবতার মধ্যেও চাপা থাকেনি।
ঘরের মধ্যে সে সময় উপস্থিত ছিলেন মহারানী অফ সোনপুর স্টেট সুচরিতা দেবী,ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত, শ্ৰীমন্ত পাল, সুধীরঞ্জন, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, বিশাখা চৌধুরী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক, সোমশ্বর রাহা আর দুজন ভদ্রলোক, যাঁদের মধ্যে মধ্যে দেখলেও নাম জানতাম না, পরে ঐ রাত্রেই জবানবন্দি নেবার সময় জেনেছিলাম,রঞ্জন রক্ষিত ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী। এঁদের মধ্যে রঞ্জন রক্ষিত শেয়ার মার্কেটের একজন চাঁই, বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী একজন ফিল্মজগতের প্রোডিউসার-ডাইরেকটার।
.
কিরীটীর পরামর্শমতই বার-রুমে রজত লাহিড়ীকে সামনে রেখে কিরীটী তার জেরা শুরু করল—প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে সেই ঘরে একের পর এক ডেকে এনে।
প্রথমেই ডাক পাঠানো হল মীরজুমলার সাহায্যে প্রেসিডেন্টকে। তিনি তাঁর নিজস্ব ঘরের মধ্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
ডান পা-টি একটু টেনে টেনে একটা মোটা লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট এসে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।
বসুন মিঃ চক্রবর্তী, আপনিই এখানকার প্রেসিডেন্ট? প্রশ্ন করলেন রজত লাহিড়ী।
নিদিষ্ট চেয়ারটা টেনে একটু যেন কষ্ট করেই বসতে বসতে প্রেসিডেন্ট মৃদুকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।
আপনার ডান পায়ে কি কোন দোষ আছে নাকি মিঃ চক্রবর্তী? হঠাৎ প্রশ্ন করে এবার কিরীটী।
কিরীটীর দিকে না তাকিয়েই মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন প্রেসিডেন্ট, আর বলেন কেন, old age-এর বায়নাক্কা কি একটা! রিউম্যাটিজ, এনলার্জ প্রস্টেট, তার উপরে আবার ক্রনিক ব্রংকাইটিস। বলার সঙ্গে সঙ্গেই বারকয়েক খুকখুক করে কাশলেন রাজেশ্বর চক্রবর্তী। নেহাৎ এরা ছাড়ে না, নাহলে এ বয়সে আর এইসব ঝামেলা পোষায় বলে যেন কথাটা শেষ করলেন কোনমতে!
চোখেও তো দেখছি আবার কালো চশমা ব্যবহার করছেন! চোখেও কোন দোষ আছে। নাকি মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী আবার শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। সে তো আজ নয়, বহুদিন থেকেই ভুগছি, হাইপার মেট্রোপিয়া না কি ডাক্তারেরা বলেন। জবাব দিলেন রাজেশ্বর।
হুঁ। তা শুনেছেন বোধ হয় দুঃসংবাদটা?
হ্যাঁ, সত্যসিন্ধুবাবু—আপনাদের ঐ সুব্রতবাবু একটু আগে মিঃ পালের সঙ্গে আমার অফিসঘরে গিয়ে সুসংবাদটা দয়া করে শুনিয়ে এসেছেন। চমৎকার ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন বটে সুব্রতবাবু। সত্যসিন্ধু! সত্যের একেবারে সাক্ষাৎ মূর্তি! বলেই আবার বার কয়েক কেশে নিলেন।
কিরীটী যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে রাজেশ্বর চক্রবর্তী বলে উঠলেন, তা দেখুন—ভাল কথা, আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি শেষ করলেন কথাটা।
জবাব দিলাম আমিই, ওর নামটা শোনেননি? কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়? মানে সেই শখের গোয়েন্দা–
হ্যাঁ।
সুখী হলাম মিঃ রায় আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তা দেখুন মিঃ রায়, আমি বলছিলাম নামেই এখানকার প্রেসিডেন্ট আমি। কাজকর্মের মধ্যে কেবল হিসাব-নিকাশটাই রাখতে হয় বৈকালী সঙ্ঘের। অবিশ্যি ঐ সঙ্গে এখানকার ডিসিপ্লিন রাখবারও দায়িত্ব একটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে। কিন্তু এখানকার মেম্বারদের পার্সোনাল ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই।
কথাটা একটু স্পষ্ট করে যদি বলেন মিঃ চক্রবর্তী? প্রশ্ন করলেন লাহিড়ীই এবার।
বলছিলাম এরা যদি কেউ পরস্পরের প্রেমে পড়ে বা আত্মহত্যা করে, সে ব্যাপারে আমি আপনাদের কি সাহায্য করতে পারি বলুন? আপনাদের ঐ সত্যসিন্ধুবাবুকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, কিছুদিন তো এখানে উনি যাতায়াত করেছেন, এখানকার হালচালও নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছেন। আমার সঙ্গে এই সঙ্ঘের ঐ প্রেসিডেন্টের পদটি ছাড়া আর বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। নতুন মেম্বার এলে তার পরিচয়টা করিয়ে দিই একবার হলঘরে এসে, নচেৎ হলঘরেই বলুন, বারই বলুন বা এ বাড়ির অন্য কোন জায়গাই বলুন, কখনও আমি পা বাড়াই না। বলে আবার বার দুই কাশলেন।