দেখলাম যে কজন নরনারীকে প্রায় মিনিট কুঠি-পঁচিশ পূর্বে বাগানের মধ্যে সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে চিত্রার্পিতের মত দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখে গিয়েছিলাম, তাঁরা তখনও সেইখানেই যে যার দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তেমনি। এবং মনোজ দত্তও ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন আবার বাগানের মধেফিরে এসেছেন প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে। আমাদের পদশব্দেওঁরা সকলেই একবার মুখ তুলে তাকালেন। কিরীটীও দেখলাম সেই মৃদু চন্দ্রালোকে সকলের মুখের দিকে পর পর একবার তাকিয়ে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি দিল।
কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কিরীটী লাহিড়ীকে সম্বোধন করে নিম্নকণ্ঠে কি যেন বলল।
লাহিড়ী দণ্ডায়মান নরনারীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যান, সকলে হলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমরা আসছি। আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমাদের কিছু কথা আছে।
এতক্ষণ তাঁরা যেন সকলে ঐ বিশেষ নির্দেশটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সকলেই একে একে স্থানত্যাগ করলেন।
ধীরে ধীরে অনেকগুলো পদশব্দ বাগানের অপর প্রান্তে আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল।
অদ্ভুত স্তব্ধ চারিদিক। মধ্যে মধ্যে কেবল মৃদু পত্রমর্মর ও একটানা একটা ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।
মৃতদেহ ঠিক পূর্ববৎ বেঞ্চের উপরে উপবিষ্ট রয়েছে।
পকেট থেকে পেনসিল-টচটা বের করে টর্চের আলো ফেলে পায়ে পায়ে কিরীটী মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।
মৃতার চিবুক স্পর্শ করে, মুখে টর্চের আলো ফেলে ক্ষণকাল সেই মৃত্যুনীল মুখখানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, সত্যিই বিষ সুব্রত।
শুধু বিষই নয়। এই যে বিষ-পাত্রও পেয়েছি! বলতে বলতে পকেট থেকে পেগ গ্লাসটা বের করে কিরীটীর সামনে এগিয়ে ধরলাম।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে বার দুই ঘুরিয়ে দেখে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী বললে, এ যে দেখছি সুরাপাত্র! মিত্রা সেনের কি সুরাসক্তি ছিল নাকি?
না, আমি কখনও দেখিনি এবং সকলে তাই বললেনও এখানে।
তাই তো মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সুইসাইড নয় তো?
অসম্ভব বলে স্ত্রী-চরিত্রে কোন কিছুই নেই। তাই সে সম্ভাবনাটাও আমাদের চিন্তা থেকে বাদ দিতে পারব না। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে জীবনে যার মধুযামিনী এমনি করের আসন্ন হয়ে উঠেছিল, কোন্ দুঃখে সে আত্মহত্যা করতে যাবে। তাছাড়া এ বিবাহে যখন দুজনেই মন দেওয়া-নেওয়ার পর্বটা সমাপ্ত করে অগ্রসর হয়েছিল তখন আচমকা এমনি করে আত্মহত্যাই বা একজন করতে যাবে কেন?
কিরীটীর কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয়।
কিরীটী আবার বললে,সে যাই হোক, এখানে মৃতদেহের কাছেই পেগ গ্লাসটা যখন পাওয়া গিয়েছে অবশ্যই তার একটা তাৎপর্য আছে। তা সে মিত্রা সেন কোনদিন ড্রিঙ্কে অভ্যস্ত থাকুন বা নাই থাকুন। তাছাড়া আরও একটা কথা এর মধ্যে ভাববার আছে। মিত্রা সেনের মত মেয়ে যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তো এই বিশেষ স্থানটি ও সময় বেছে নিলেন কেন? তাঁর চরিত্রের ভ্যানিটির কথাটাও আমাদের ভুললে চলবে না।
কথাগুলো বলে কিরীটী চারপাশে আলো ফেলে ফেলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর আবার ক্ষীণকণ্ঠে বললে, মৃতের চোখেমুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন সুস্পষ্ট আছে বটে। তবে মৃতদেহের সহজ পশ্চার দেখে মনে হয় মৃত্যুর কারণ যে বিষই হোক না কেন, সেটা অত্যন্ত তীব্র ও দ্রুত কার্যকরী ছিল। আর খুব সম্ভবত ব্যাপারটা যা মনে হচ্ছে, যদি হত্যাই হয়ে থাকে, নিশ্চিন্ত বিশ্বাসেমিত্রা সেন হত্যাকারীর হাত থেকে বিষ গ্রহণ করে পান করেছিলেন। তারপর ভাববারও আর সময় পাননি, অবধারিত মৃত্যুকে বরণ করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে হয় হত্যাকারী পূর্ব হতেই জানত আজ রাত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিত্রা সেন এখানে আসবেন বা থাকবেন, না হয় তাঁরই পূর্ব পরিকল্পনা বা প্ল্যান মত মিত্রা সেনকে এখানে কোন এক সময় আজ রাত্রে আসতে হয়েছিল। পরের ব্যাপারটাই যদি সত্যি হয় তো বলতে হবে হত্যাকারী পূর্ব থেকেই বিষ নিয়ে প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু একটা কথা কিরীটী–বাধা দিলাম আমি।
কি?
ধরেই যদি নেওয়া যায় যে, ঐ পেগ গ্লাসেই মিত্রা সেনকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, তাহলে মদ ভিন্ন কি এমন পানীয় যা মিত্রা সেনকে বিষ মিশ্রিত করে হত্যাকারী তার হাতে তুলে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, কথাটা অবিশ্যি ভাববার। তবে তারও পক্ষে তোর একমাত্র যুক্তি তো যে, মিত্রা সেনের ড্রিঙ্ক করার হ্যাবিট ছিল না, এই তো? কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবনে কখনও যে তিনি ড্রিঙ্ক করেননি বা করতে পারেন না, তারও তো কোন মানে নেই। দৈব কার্যকারণ বলে একটা কথা আছে, মানিস তো?
তা মানি। তাই যদি হবে তো সে এমন কেউ হওয়া দরকার যার দ্বারা সেটা হওয়া সম্ভব!
সে তো এখানেই কেউ হতে পারে।
মানে?
মানে এখানে সকলের সঙ্গেই তো তার ভাব ছিল, হৃদ্যতা—অর্থাৎ তোমার অশোক রায় থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরী বা স্বয়ং মহারানী অফ সোনপুরও তো হতে পারেন। বলেই কিরীটী হেসে ফেললে, কিন্তু থাক সে কথা, স্বেচ্ছাকৃত বিষগ্রহণ যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই সে সময় দ্বিতীয় কোনোনরনারীর সুনিশ্চিত এখানে আবির্ভাব ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, ঐ সঙ্গে একটি কথা ভুললে চলবে না সুব্রত, মিত্রা সেনের বিবাহের দিন অসন্ন হয়ে এসেছিল এবং বর্তমানের অতি আধুনিক ইঙ্গ-বঙ্গ সোসাইটির সে ছিল অন্যতম। কিন্তু আর এখানে নয়। রাত অনেক হল, এবারে এখানকার ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়গণকে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। পুলিসের হুমকি দিয়ে অনেক্ষণ তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। কি বলেন মিঃ লাহিড়ী?