প্রচুর পসার।
চেম্বারের ঐ নির্দিষ্ট টাইমটা ছাড়াও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে হাসপাতাল ও প্রাইভেট কল অ্যাটে করবার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুজঙ্গ ডাক্তার সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত যে রাত নটার পর বাড়িতে একবার ঢুকলে, তখন হাজার টাকা অফার করলেও তাঁকে দিয়ে কোন রোগী দেখানো তো যাবেই না, এমন কি তিনটা থেকে পরদিন ভোর ছটার আগে পর্যন্ত তিনি নিজে কোন ফোন-কলও অ্যাটেণ্ড করবেন না। ঐ সময়ের মধ্যে যদি কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে বা করতে হয় তো বাড়ির অন্য লোক মারফৎ করতে হবে।
আশ্চর্য! গত পাঁচ বৎসর ধরেই শোনা যায়, প্রতিদিন রাত্রি নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত, ঐ আট ঘণ্টা সময় তিনি নাকি সমস্ত দায়িত্ব ও কাজকর্ম থেকে নিজেকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিজের শয়নঘর ও তৎসংলগ্ন লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে রাখেন।
বলতে গেলে বাইরের জগতে তো নয়ই, এমন কি তাঁর গৃহেও ঐ আট ঘণ্টা সময় তো তিনি সকলের কাছ থেকেই দূরে বিচ্ছিন্ন ও একক হয়ে থাকেন।
শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের বয়স নাকি প্রায় বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। অকৃতদার। এবং নারী জাতি সম্পর্কেও আজ পর্যন্ত তাঁর কোনরূপ দুর্বলতার কথা কেউ কখনও শোনেনি।
সংসারে আপনার জন বলতে বিকলাঙ্গ, অর্থাৎ ডান পা-টি খোঁড়া, বেকার একটি সহদর ভাই আছে। বয়সে ভাইটি ডাক্তারের থেকে আট বৎসরের ছোট। নাম ত্রিভঙ্গ। তাই ত্রিভঙ্গ চৌধুরীও মৃখ নয়। বি. এ. পাস। ত্রিভঙ্গ বিবাহিত। ভুজঙ্গ ডাক্তারই ত্রিভঙ্গের বিবাহ দিয়েছেন। অপূর্ব সুন্দরী বি. এ. পাস একটি গরীব মেয়ের সঙ্গে। সেও বছর ছয়েক হবে। নাম মৃদুলা। আর আছে বছর সাড়ে চারের মৃদুলা ও ত্রিভঙ্গর একমাত্র পুত্রসন্তান অগ্নিবান।
ভাইপোটি শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের অত্যন্ত প্রিয়। বাড়িতে আর লোকজনের মধ্যে ভুজঙ্গের অনেক দিনের খাসভৃত্য, রামচন্দ্র বা রাম। সে একমাত্র ভুজঙ্গেরই কাজকর্ম করে। দ্বিতীয় ভৃত্য হচ্ছে ভূষণ। একটি ঝি রাতদিনের, সুরবালা, রাঁধুনী বামুন কৈলাস, সোফার হরিচরণ ও নেপালী দারোয়ান রাণা।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের ইদানীং পসার খুব বৃদ্ধি হলেও ফিজ পূর্বের মতই রেখেছেন, বাড়ান নি। চেম্বারে ষোল ও বাড়িতে বত্রিশ। শোনা যায় ফিজ সম্পর্কে ভুজঙ্গ ডাক্তারের নাকি অপূর্ব একটা নীতি ছিল সেই প্র্যাকটিসের শুরু থেকেই।
ফরেন ডিগ্রী নিয়ে দুশ বৎসর পূর্বে যেদিন তিনি পার্কসাকাস ট্রাম-ডিপোর কাছাকাছি বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরেই পঞ্চাশ টাকা মাসিক ভাড়ায় ছোট একখানা ত্রিকোণাকার ঘর নিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেন, সেই দিন থেকেই তাঁর ফিজ তিনি চেম্বারে মোল ও গৃহে বত্রিশ ধার্য করেন।
এবং সে-সময় নতুন সদ্য-বিলাতফেরত ডাক্তারদের যা অবস্থা হয়ে থাকে, দিনের পর দিন রোগীর প্রত্যাশায় বারনারীর মতোই আপনাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে, রাস্তার চলমান পদধ্বনির দিকে কান পেতে, নিজের প্রকোষ্ঠেরই কড়িকাঠ গণনা করতে হত, সে-সময়ও কচিং কখনও কোন রোগী তাঁর চেম্বারে এলে সর্বাগ্রে তাকে বলতেন, জানেন তো আমার ফিজ! এখানে ষোল, বাড়িতে হলে বত্রিশ। ফ্রি কনসালটেশন আমি করি না।
ফলে যা হবার তাই হত।
ভাগ্যে সপ্তাহে একটি রোগী জুটত কিনা সন্দেহ।
বন্ধুবান্ধবেরা যদি কখনও বলত, গোড়াতে ফিজটা কমাও ভুজঙ্গ। পরে যখন পসার বাড়বে ফিজ ক্রমে বাড়িয়ে যাবে।
ভুজঙ্গ নাকি হেসে জবাব দিতেন, উহুঁ। Start ও finish আমার একই থাকবে, শুরুতে যা ধরেছি শেষেও তাই রাখব।
উপোস করে মরবে যে!
মরবে না ভুজঙ্গ চৌধুরী। প্রতিভার যাচাই অত সহজেই হয় না হে। কয়লাখনির মধ্যে যে হীরা থাকে তাকে খুঁজে বের করতে হলেও সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষা তাদেরও দিতে হবে বৈকি। আর আমাকেও সেটা সহ্য করতে হবে।
এত বিশ্বাস!
ঐ বিশ্বাসের উপরেই তো দাঁড়িয়ে আছি হে।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের প্রতিভা যে সত্যিই ছিল এবং সে যে মিথ্যা দম্ভ প্রকাশ করেনি, ক্রমে সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছিল। লোকে একদিন তাকে চিনতে পারলে। সেই সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারও বদল হল। বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ হল।
এবারে ঐ অঞ্চলেরই একেবারে ট্রাম-রাস্তার উপরে বিরাট একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় সম্পূর্ণ একটা ফ্ল্যাট নিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে ভুজঙ্গ নতুন চেম্বার ও নার্সিংহোম করলেন।
তারপর দেখতে দেখতে গত পাঁচ বৎসরে যেন হু-হু করে ভুজঙ্গ ডাক্তারের পসার ও খ্যাতি শহর ও শহরের আশেপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ফিজ কিন্তু তাঁর মোল-বত্রিশের উপরে গেল না। কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। এক কথায় সকলকেই তিনি তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই।
প্রতিভা থাকে অবিশ্যি অনেকেরই কিন্তু সেই প্রতিভার বিকাশের ও স্বীকৃতিলাভের সৌভাগ্য কজনের হয় সত্যিকারের! সেই দিক দিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তার নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।
চেম্বারে প্রত্যহ রোগীর ভিড় এত থাকে যে, সব রোগীকে তিনি প্রত্যহ পূর্ব অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া সত্ত্বেও দেখে উঠতে পারেন না। ক্ষুন্ন মনে অনেককেই পরের দিনের আশায় ফিরে যেতে হয়। কারণ যাকে তিনি পরীক্ষা করেন সময় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই পরীক্ষা করে থাকেন।
এনগেজমেন্টের খাতায় পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত রোগী সব বুক হয়ে থাকে চেম্বারে।