আমার সৃষ্টি?
তাই নয় তো কি?
তা তো বলবেই! আজ ওর চাইতে বেশি প্রাপ্য আর আমার কি থাকতে পারে!
শোন, আবোল-তাবোল কল্পনার দ্বারা নিজেকে মিথ্যা পীড়িত করো না। বাড়ি যাও। কয়েকদিন তোমার ভাল করে বিশ্রাম ও সুনিদ্রার দরকার। এই নাও। এই শিশি থেকে একটা ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ো, দেখবে খুব সাউণ্ড স্লিপ হবে।
ধন্যবাদ। ঘুমের ওষুধের দরকার যদি আমার হয় তো তোমার কাছে হাত পাততে হবে না।
তারপরই সব স্তব্ধ।
বাথরুমের আলোটা আবার জ্বলে উঠল।
দেখলাম ইতিমধ্যে কখন একসময় কিরীটী বাল্বটা হোলডারে লাগিয়ে দিয়ে কাঁচের পাল্লাটা আটকে দিচ্ছে।
আমরা দুজনে বাথরুম থেকে আবার ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।
আল্লাবক্স ও বানু বেগম নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের মধ্যে যেন কি কথাবার্তা বলছিল, আমাদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে আমাদের মুখের দিকে তাকাল দুজনেই।
কিরীটী আল্লাবক্সকে চোখের ইঙ্গিতে কি যেন নির্দেশ দিল দেখলাম। আল্লাবক্স এগিয়ে গিয়ে একটা ইলেকট্রিক বোম টিপে দিল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘরের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল, ঘরে এসে প্রবেশ করলেন আমাদের পূর্ব পরিচিত ডাঃ মিত্র।
ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম।
ডাক্তার মিত্র আমাদের সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে মাঝামাঝি নেমেছি হঠাৎ নিচে থেকে জুতোর শব্দ কানে এল।
তারপরই চোখে পড়ল স্যুট-পরিহিত এক পুরুষ-মূর্তি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। আমি হঠাৎ গায়ে কিরীটীর নিঃশব্দ অঙ্গুলি-সংকেত স্পর্শ পেয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম সিঁড়ির ধাপের উপরেই। আগন্তুক ধীরে ধীরে উঠে নিঃশব্দে আমাদের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেল।
আগন্তুক কিন্তু আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং পাশ দিয়ে উঠে যাবার সময় যেন মনে হল পাছে আমাদের পরস্পরের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে যায়, সেজন্য বিশেষ একটু সতর্কতা অবলম্বন করেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু মুখটা ঘুরিয়ে নিলেও আগন্তুককে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। বিখ্যাত কয়লা-ব্যবসায়ী শ্ৰীমন্ত পাল, বৈকালী সঙ্ঘের অন্যতম মেম্বার।
বাকি সিঁড়ি কটা অতিক্রম করে নিচে নেমে আসতেই প্রহরারত গুলজার সিংয়ের সঙ্গে দেখা হল।
গুলজার সিং নিঃশব্দে আমাদের মুখের দিকে তাকাল এবং নিঃশব্দ সে দৃষ্টির মধ্যে আর কিছু না থাকলেও খানিকটা সন্দেহ যে উঁকি দিচ্ছিল সেটা বুঝতে কিন্তু কষ্ট হল না। কিন্তু কোনরূপ বাক্যব্যয় না করে সে যেমন দরজা খুলে দিল, আমরাও তেমনি বিনা-বাক্যব্যয়ে নার্সিং হোম থেকে বের হয়ে এলাম।
আমাদের পশ্চাতে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
১১. হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত
হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত গাড়িটা খানিকটা দূরেই পার্ক করে রেখেছিল। আমরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, শ্ৰীমন্ত পালের চকচকে ফোর্ড কনসাল গাড়িটা নার্সিং হোমের সামনেই পার্ক করা আছে। অদূরে রাস্তার লাইটপোস্টের আলোয় দেখলাম, গাড়ির মধ্যে কোন ড্রাইভার নেই। শূন্য গাড়িটা পার্ক করা আছে মাত্র। গাড়ি ও গাড়ির নাম্বার দুটোই আমার যথেষ্ট পরিচত। হীরা সিং সজাগই ছিল।
আমারা এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে ঘাড় ফিরিয়ে হীরা সিং প্রশ্ন করল, কিধার যায়গা সাব?
কোঠি চল। কিরীটী বললে।
প্রথম থেকেই অর্থাৎ সেই বাথরুম থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন চুপ করে গিয়েছিল। একটি কথাও বলেনি। বুঝতে পারছিলাম কিরীটীর মনের মধ্যে বিশেষ কোন একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই আমিও কথা বলা নিরর্থকভেবে চুপ করেই গিয়েছিলাম।
গাড়ি ছুটে চলেছে নিঃশব্দ গতিতে রাত্রির জনহীন পথ দিয়ে। দু-পাশের বাড়িগুলো যেন ফ্রেমে আঁকা ছবির মত মনে হয়।
রাস্তার দু-পাশে লাইটপোস্টের আলো ও রাত্রির অন্ধকার মেশামেশি হয়ে যেন আলোছায়ার একটা রহস্য গড়ে তুলেছে। সেই আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে জাগরণ-ক্লান্ত চোখ দুটো আমার যেন কেমন জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ কিরীটীর কথায় চমকে ওর মুখের দিকে ফিরে তাকালাম।
আমাদের নামবার সময় সিঁড়ি দিয়ে যে লোকটা উঠে গেল তাকে চিনতে পেরেছিস সুব্রত?
হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল।
কিন্তু আমি যদি বলি সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়!
তার মানে? বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শ্ৰীমন্ত পাল নয়। কিরীটী আবার বললে।
কি বলছিস কিরীটী?
ঠিকই বলছি। যদিও সামনাসামনি একদিন মাত্র ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলাম, তবুও বলতে পারি সিঁড়িতে যার সঙ্গে একটু আগে আমাদের দেখা হয়েছে সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়। হুবহু শ্ৰীমন্ত পালেরই ছদ্মবেশে অন্য কেউ। তবে এও বলব, সে যেই হোক তার অদ্ভুত একটা দক্ষতা আছে ছদ্মবেশ ধারণের। কিরীটীর কথাগুলো যতখানি বিস্ময় ঠিক ততখানি কৌতূহলের উদ্রেক করে আমার মনে। এবং আমি কোন কথা বলবার পূর্বেই কিরীটী আবার বলে, আচ্ছা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ডাক্তারের চেম্বারের দূরত্ব কতটা হতে পারে?
মনে মনে একটা হিসাব করে বললাম, মাইল তিন কি সাড়ে তিনের বেশি হবে বলে তো মনে হয় না।
তাহলে অ্যাভারেজ স্পীডে গাড়ি চালালে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে কত সময় লাগতে পারে?
তা রাস্তা খালি থাকল পনের-মোল মিনিটের বেশি নিশ্চয় নয়।