এতক্ষণে ব্যাপারটা যেন কিঞ্চিৎ বোধগম্য হয় আমার।
রাত্রে ডাঃ চৌধুরীর নার্সিং হোমে হানা দেবার জন্য কিরীটী চমৎকার একটি প্ল্যান দাঁড় করিয়েছে।
.
গাড়িতে উঠে বসে বললাম, এখন কোথায়?
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে কিরীটী বললে, সোজা রসা রোডে আল্লাবক্সের গৃহে। তারপর তাঁরই গাড়িতে আমরা যাব ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর নার্সিং হোমে।
রাত ঠিক এগারোটা বেজে দশ মিনিটে আল্লাবক্সের গাড়িতে চেপে আমরা তিনজন পার্ক সাকাসের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর নার্সিং হোমের সামনে এসে নামলাম।
আল্লাবক্সই এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে যে ইলেকট্রিক বেল তার বোতামটা টিপল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল, সামনে দাঁড়িয়ে: বিরাটকায় গুলজার সিং।
আল্লাবক্স ও গুলজার সিংয়ের মধ্যে কি কথাবার্তা হল উর্দুতে। আমাদের সকলকে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে পুনরায় গুলজার সিং ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
গুলজার সিংকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে আমরা তিনজনে দোতলায় উঠলাম। ডাক্তারের চেম্বারের দরজা অতিক্রম করে আমরা প্যাসেজটা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সুসজ্জিত ঘরটি ওয়েটিং রুম বলেই মনে হল।
গুলজার সিং আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রস্থান করল। আমরা তিনজন তিনটি চেয়ারে বসলাম এবং বসবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে এসে প্রবেশ করল একজন স্যুট পরিহিত তরুণ। আগন্তুক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাবক্স উঠে দাঁড়িয়ে ইংরাজীতে প্রশ্ন করলেন, বানু বেগম কেমন আছে ডাঃ মিত্র?
সেই রকমই। খুব restless। ডাঃ মিত্র বললেন।
অতঃপর আল্লাবক্স আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ডাক্তারের সঙ্গে।
ডাঃ মিত্র আমাদের নমস্কার জানিয়ে বললেন, আসুন আপনারা। চার নম্বর কেবিনেপেসেন্ট আছে।
ঘরের মধ্যস্থিত দুটি দ্বারপথের একটি দ্বার দিয়ে প্রথমে এগিয়ে গেলেন ডাঃ মিত্র, তাঁর পশ্চাতে আমরা তিনজন অগ্রসর হলাম তাঁকে অনুসরণ করে।
সরু একটা প্যাসেজ, ডান দিকে পর পর অনুরূপ চারটি দরজা এবং প্রত্যেক দরজার মাথায় পর পর ইংরাজীতে এক দুই তিন চার ক্রমিক নম্বর লেখা।
পরে বুঝেছিলাম একটা হলঘরকেই সম্পূর্ণ সিলিং পর্যন্ত পার্টিশন তুলে পর পর চারটি কিউবসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এবং সেই কিউবসগুলোই এক-একটি কেবিন। প্রত্যেকটি কেবিনের সঙ্গেই একটি করে ছোট্ট অ্যাটাচড় বাথরুম। চার নম্বর অর্থাৎ সর্বশেষ কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাঃ মিত্র বললেন, যান আপনারা ভিতরে কিন্তু রোগিণীর কণ্ডিশন ভাল নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টা করবেন। জানেন তো—আল্লাবক্সের দিকে তাকিয়ে এবারে ডাঃ মিত্র বললেন, রাত্রে আমরা নার্সিংহোমে কখনও কোনও ভিজিটার্সকে আসতে দিই না। ডক্টর চৌধুরীর কড়া আদেশ আছে। সম্পূর্ণ আমার নিজের রিস্কে আসতে দিয়েছি আপনাদের, কেবলমাত্র রোগিণীর কথা ভেবেই।
জবাব দিল আল্লাবক্স, আপনার এ উপকারের কথা আমরাও ভুলব না ডাঃ মিত্র।
মৃদু হেসে ডাঃ মিত্র যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই আবার প্রস্থান করলেন। আমরা তিনে চার নম্বর কেবিনের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে আল্লাবক্স কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বেডে শুয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে এক রোগিণীকে আমরা ককাতে শুনলাম রোগযন্ত্রণায়।
আল্লাবক্স বেডের কাছে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন, বানু—
ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রোগিণী আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন। অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। রোগশীর্ণ মুখখানি, তবু তাতে যেন লেগে রয়েছে কষ্টসাধ্য একটুখানি হাসি।
ভাইজান—
কোনখান থেকে শুনেছিলে তুমি পরশু রাত্রে মানুষের গলার আওয়াজ?
বাথরুমের মধ্যে যাও। ঢুকতে ডান দিককার দেওয়ালের গায়ে দেখবে একটা কাঁচের চৌকো বক্সের মধ্যে আলোটা বসানো আছে। সেই কাঁচের বাক্সটার সামনে দাঁড়াতেই সে রাত্রে মানুষের গলা শুনেছিলাম।
অতঃপর আর সময়ক্ষেপ না করে প্রথমে কিরীটী ও সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাতে আমি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।
বাথরুমের আলোর সুইচটা ঘরে ঢুকবার মুখেই কিরীটী অন্ করে দিয়েছিল। বাথরুমটা ছোট্ট। একটা স্নানের টব একপাশে ও দেওয়ালে বসানো একটা সিঙ্ক ও কমোড।
ঘরে ঢুকতেই আমাদের নজরে পড়ল, ডান দিককার দেওয়ালের গায়ে গাঁথা চৌকো একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে একটি বাল্ব জ্বলছে।
ঘষা কাঁচের তৈরি আলোর বাক্সটি। হাত দিয়ে একবার পরখ করে কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল, তারপর পকেট থেকে ছুরি বার করল। ছুরির ইস্পাতের তৈরি শক্ত ফলাটা বাক্সটার এক জায়গায় বসিয়ে সামান্য একটু চাড় দিতেই ডালাটা খুলে গেল, হাত ঢুকিয়ে। কিরীটী বাল্বটা খুলে নিতেই ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল ও সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল একটি নারীর কণ্ঠস্বর। অত্যন্ত স্পষ্ট।
হ্যাঁ, স্পষ্ট কথাটাই তোমাকে আমি বলতে এসেছি। আজ এবারে আমি মুক্তি চাই।
জবাব শোনা গেল গম্ভীর পুরুষ-কণ্ঠে,তোমাকে আমি বেঁধে রাখিনি, ইচ্ছে করলেই তো তুমি যখন খুশি চলে যেতে পার। কিন্তু আমার কথা যদি শোন তো বলি এভাবে ছেলেমানুষি করে লাভটাই বা কি?
ছেলেমানুষি!
তাছাড়া আর একে কি বলব?
তাই বটে! অদৃশ্য নাগপাশে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে—
সেও তোমার ভুল ধারণা। বাঁধনই যদি মনে কর তো সেটা তোমার নিজেরই সৃষ্টি।