কিরীটী সোফাটার উপরে বেশ আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল। বুঝলাম আমাদের নৈশ অভিযানের এখনও দেরি আছে। মাথার মধ্যে তখনও আমার কিরীটীর কাছ থেকে শোনা সংবাদ দুটিই ঘোরাফেরা করছিল। বিশেষ করে অশোক রায় ও মিত্রা সেনের বিবাহের ব্যাপারটা। দীর্ঘদিন ধরে একান্তভাবে বোহিমিয়ান জীবন কাটিয়ে আজ হঠাৎ মিত্রা সেন ঘর বাঁধবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল কেন! এতদিনে কি তবে সে বুঝতে পেরেছে জীবনে ঘর বাঁধবার প্রয়োজনীয়তা! কিন্তু তাও তো বিশ্বাস করতে মন চায় না। এখনও তার হাবভাব, চালচলন ও ব্যবহারের মধ্যে এমন একটা ভোগের উজ্জ্বলতা রয়েছে এবং সেই উচ্ছঙ্খলতা দীর্ঘদিন ধরে রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছে, সেটাকে সে অস্বীকার করতে কি এত সহজেই পারবে এবং তার মত একজন তীক্ষ্ণধী মেয়ের পক্ষে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে তার প্রতি অশোক রায়ের আকর্ষণটাকে আর যাই বলা যাক,প্রেম নয়। বরং বলা চলে ক্ষণিকের একটা মোহ। তাই যদি হয়, সেই মোহটা যখন কেটে যাবে তখনকার পরিস্থিতিটা কি ও ভাবছে না একবারের জন্যও? না ওসবের কোন বালাই-ই নেই ওদের এই বিবাহ ব্যাপারে কোনও একটা বিশেষ কারণেই এই যোগাযোগটা ঘটছে!
বুঝতে পারিনি কিরীটীর চিন্তাধারাটাও আমার মত একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। তার প্রশ্নে যেন তাই হঠাৎ পরক্ষণেই চমকে উঠলাম।
অশোক রায় ও মিত্রা সেনের বিয়ের ব্যাপারটা তোর কি মনে হয় সুব্রত? কিরীটী সহসা প্রশ্ন করল।
মানে? কি ঠিক তুই বলতে চাইছিস?
বলছি, বিয়েটা ওদের সত্যি সত্যিই শেষ পর্যন্ত হবে বলে তোর মনে হয়?
সে আবার কি! এই তো বললি অশোক রায় তার বাপকে বিয়ের তারিখটা পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছে!
তা অবশ্য দিয়েছে। কিন্তু মক্ষীরানীর বিয়ে হয়ে গেলে বৈকালী সঙ্ঘের কি হবে?
কি আবার হবে, সিংহাসন শূন্য নাহি রবে। তাছাড়া বিয়ে করলেই যে মিত্রা সেন সঙ্ঘ ছেড়ে দেবে তারও তো কোনো মানে নেই!
তা অবশ্য নেই। তবে চিরযৌবনা কুমারী মক্ষীরানীকে সকলে যে চোখে দেখত অশোক রায়ের স্ত্রী হলে কি আর তারাই সে চোখে তাকে দেখবে, না অশোক রায়ই সেটা তখন পছন্দ করবে?
অশোক রায় তো জেনেশুনেই বিয়ে করছে। আর এতদিনের অভ্যাস মিত্রা সেনের ছাড়াতে। চাইলেই কি ছাড়তে সে পারবে নাকি! যেমন গর্ধবচন্দ্র তেমন তার ফল ভোগ করাই উচিত। সারাদেশে যেন তার মিত্রা সেন ছাড়া পাত্রী ছিল না!
হঠাৎ ঐ সময় আমাদের কথার মাঝখানে ঘরের ফোন ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। কিরীটী সোফা থেকে উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো! কে? হ্যাঁ, আমিই কথা
বলছি, বলুন। ব্যবস্থামত নার্সিং হোম থেকে কল এসেছে। যাচ্ছি। হ্যাঁ—এক্ষুণি যাচ্ছি। মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই আপনার ওখানে পৌঁছে যাব।
কিরীটী রিসিভারটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ডাক এসে গিয়েছে। মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই আমি প্রস্তুত হয়ে আসছি। এক্ষুণি আমরা বেরুব, তুই একটু বোস্।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
বসে বসে একটা পিকটোরিয়াল ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম, পদশব্দে মুখ তুলে তাকাতেই যেন হঠাৎ চমকে উঠলাম। দীর্ঘকায় এক পাঠান আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরিধানে সালোয়ার পাঞ্জাবি, মাথায় পাঠানী পাগড়ি। মুখে চাপদাড়ি,পাকানো পুরুষ্টু গোঁফ।
গলাটা একটু ভারী ভারী করে কিরীটী কথা বলল, আদাবস্ সাব…
কি ব্যাপার? হঠাৎ এ বেশে কেন? মৃদু হেসে প্রশ্ন করলাম।
বানু বেগমের ভাই পীর খাঁ। এ বেশে না গেলে চলবে কেন?
তা যেন হল, কিন্তু পাঠান পীর খাঁর সঙ্গে আমাকে বাঙালী দেখলে লোকের সন্দেহ হবে না?
হওয়াই স্বাভাবিক। আর এক প্রস্থ সাজসজ্জা তোর জন্যেই ঘরে রেডি করে এসেছি। বি কুইক! ভোল পাল্টে আয়।
কিরীটীর ল্যাবরেটারি ঘরের সংলগ্ন ছোট একটি অ্যান্টিরুমের মত আছে, তার মধ্যে ছদ্মবেশ ধারণের সব রকম ব্যবস্থাই থাকে আমি জানতাম। বিনা বাক্যব্যয়ে আমি উঠে সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। একটা টেবিলের উপরে পাঠান-বেশনেবার সবই প্রস্তুত ছিল। তাড়াতাড়ি শুরু করে দিলাম কাজ।
মিনিট আষ্টেকের মধ্যে যখন প্রস্তুত হয়ে কিরীটীর সামনে এসে দাঁড়ালাম, ক্ষণেকের জন্যে আমার আপাদমস্তকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে সে বললে, ঠিক আছে। তোর নাম হবে, আয়ুব খাঁ। পীর খাঁর বোন বানু বেগমের স্বামী।…
সর্বনাশ! বলিস কি? শেষ পর্যন্ত অপরিচিত এক ভদ্রমহিলার স্বামীর প্রক্সি দিতে হবে নাকি! না ভাই, স্বামী সেজে কাজ নেই, পাঠানী খানদানী ব্যাপার, ওরা কথায় কথায় ছোরা চালায়।
ভয় নেই রে, ভয় নেই। বানু বেগম ও পীর খাঁ, ভাই ও বোনের দুজনের সম্মতিক্রমেই আজকের এ নৈশ অভিসার আমাদের arranged হয়েছে। তাছাড়া বানু বেগমের স্বামী আয়ুব খাঁ এখন বহু পথ দূরেপেশোয়ারে। চল চল—আর দেরিনয়, বানুবেগমের অবস্থা আশঙ্কাজনক, সে তার স্বামী ও ভাইকে দেখবার জন্য তার আত্মীয়ের বাড়িতে জরুরী টেলিফোন করেছিল কিছুক্ষণ আগে এবং সৌভাগ্যক্রমে দুজনেই আজ দুপুরে কলকাতায় এসে গিয়েছে। একজন লাহোর থেকে, অন্যজন পেশোয়ার থেকে। আর তার আত্মীয় নার্সিং হোমে টেলিফোনে। সেই সংবাদ দিয়ে বলেছেন, পীর খাঁ ও আয়ুব খাঁ দুজনেই নার্সিং হোমে যাচ্ছেন এখুনি।