কোথাও যাবে নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
পার্ক সার্কাসেডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার-কাম নার্সিং হোমে।
রাত্রে মানে কখন? কটার সময়?
রাত ঠিক বারোটায়।
কিন্তু তোকে অত রাত্রে সেখানে ঢুকতে দেবে কেন?
যাতে দেয় সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। রাত্রে নটার পর আসিস। এলেই যথাসময়ে সব জানতে পারবি।
কিরীটীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম বটে কিন্তু কিরীটীর মুখে শোনা অশোক রায়ের ব্যাপারটাই মনের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগল। কে সে তরুণী, যাকে প্রতি মাসে এমনি করে গত আট-নয় মাস যাবৎ ঠিক নিয়মিত মাসের প্রথমেই আড়াই হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিয়ে যাচ্ছে সে! আর কেনই বা মাসে মাসে ঐ টাকা দিচ্ছে? মিত্রা সেনের সঙ্গেই বা তাহলে অশোক রায়ের সম্পর্কটা কি! তা ছাড়া কিরীটী ইঙ্গিতে যে কথা বললে, বৈকালী সঙ্ঘের সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের একটা অলক্ষ্য যোগাযোগ আছে, সেটাই বা আসলে কি ধরনের যোগাযোগ! ভুজঙ্গ ডাক্তারকে তো গত পনের-কুড়ি দিনে কখনও দেখি নি বৈকালী সঙ্ঘে যেতে। অবশ্য লোকটার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যেও যেন কেমন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। ঠিক একেবারে নরম্যাল নয়।
.
কিরীটী বলছিল রাত্রি নটার পর তার ওখানে যেতে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত বিলম্ব যেন আর সইছিল না। সাড়ে সাতটার পরই বের হয়ে পড়লাম কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিরীটী তার বাইরের ঘরেই বসে একটা কাগজের গায়ে পেনসিলের সাহায্যে কিসের যেন নকশা আঁকছিল। আমার পদশব্দে মুখ না তুলেই বললে, আয় সুব্রত! এত তাড়াতাড়ি এলি, খেয়ে আসিসনি নিশ্চয়!
না।
ঠিক আছে, একসঙ্গে খাওয়া যাবেখন।
কিরীটীর পাশে বসে তার সামনে অঙ্কিত নকশাটার দিকে তাকালাম, কিসের নকশা রে ওটা?
ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার ও নার্সিং হোম যে ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে আছে সেই বাড়ির নকশা। বাড়িটার মালিক এককালে ছিলেন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী আলি ব্রাদার্সের ছোট ভাই মহম্মদ আলি।
একদিন ছিল মানে? এখন আর নেই নাকি?
না। নকশাটার উপরে পেনসিলের আঁচড় কাটতে কাটতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল কিরীটী।
তবে বর্তমান মালিক কে?
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
কথাটা শুনে যেন আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কিরীটী বলে কি! বর্তমানে বাড়িটার মূল্য ন্যূনপক্ষে হলেও দেড় লক্ষ টাকার কম নয়! বললাম, সত্যি বলছিস?
১০. আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুর
আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুরটা কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়াতে পারেনি পরমুহূর্তে বুঝলাম, কারণ সে হাতের নকশাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এবং আমার দিকে না তাকিয়েই পূর্ববৎ শান্তকণ্ঠে বললে, বিস্ময়ের এতে কি আছে! বর্ণচোরা আমের ধর্মই যে ওই। বাইরে থেকে অত সহজে বোঝবার উপায় নেই। মাস ছয়েক হল আলি ম্যানশনটি ডাঃ চৌধুরীর নামে রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বাড়িটার দাম দেড় লক্ষ টাকার তত কম হবে বলে আমার মনে হয় না!
তাই। তবে ক্রেতা মাত্র আশি হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। কিন্তু এর চাইতেও একটা বেশি ইনটারেস্টিং সংবাদ তোকে দিতে পারি যা তোর জানা নেই।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। ও কিন্তু তখনও হাতের আঁকা নকশাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। এবং এবারেও আমার দিকে না তাকিয়েই বললে, সংবাদটা অবিশ্যি শুভ। প্রজাপতি-ঘটিত সংবাদ।
প্রজাপতি-ঘটিত সংবাদ!
হ্যাঁ। শ্রীমান অশোক রায় শীঘ্রই বিবাহ করছেন।
কাকে?
শ্ৰীমতী মিত্রা সেনকে।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ। অশোক রায় তাঁর বাপকে গতকাল রাত্রে জানিয়েছেন এবং কিছুক্ষণ আগে রাধেশ রায় সে সংবাদটি ফোনে আমাকে জানিয়েছেন।
কিন্তু অশোক রায়ের চাইতে যে মিত্রা সেন বয়সে বড়!
তাতে কি? এ হচ্ছে বিশুদ্ধ প্রেমের ব্যাপার! পঞ্চশরের কৌতুক!
তা রাধেশ রায় আর কি বলবেন? ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুশী হতে পারেননি সংবাদটা শুনে?
তা অবশ্য হননি। কিন্তু বাপ হয়ে উপযুক্ত পুত্রের একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাঁর করারই বা কি আছে! বড়জোর তিনি বলতে পারতেন,ব্যাপারটা তিনি খুশীমনে নিতে পারছেন না। জবাবে হয়তো ছেলে বলে বসত, বিবাহটা যখন সে-ই করবে তখন পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে তার পছন্দ বা মতামতটাই সবাগ্রগণ্য।
তা বটে, তবে বিয়েটা হচ্ছে কবে? তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছে নাকি?
হ্যাঁ, আগামী মাসের ছ তারিখে মঙ্গলবার অর্থাৎ হাতে আর দিন দশ মাত্র সময় আছে।
আজ তো আর যাওয়া হল না। আগামী কাল বৈকালী সঙ্ঘে গেলেই হয়ত সেখানে সংবাদটা পেতাম।
সম্ভব না। কারণ এতদিনেও যখন কেউ সেখানকার ব্যাপারটা জানতে পারেনি, বিবাহের পূর্বে কেউ জানতে পারবে বলে মনে হয় না। বিবাহের ব্যাপারটা তাঁরা দুজনের একজনও জানাজানি করতে চায় না বলেই আমার ধারণা।
যাই বল, মুখরোচক এই সংবাদটা জানাজানি হয়ে গেলে ওদের সোসাইটিতে একটা চাঞ্চল্য দেখা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। এতকাল ধরে বহু হতভাগ্য পতঙ্গকে পুড়িয়ে মিত্রা সেন রূপিণীবহ্নিশিখাশেষ পর্যন্ত যৌবনের প্রান্তসীমায় এসে মালাবদল করছেন, একটা সেনসেশনের ব্যাপারই বটে!
জংলি এসে ঢুকল। বললে, মা জিজ্ঞাসা করলেন, খানা টেবিলে এখন দেওয়া হবে কিনা?
হ্যাঁ, দিতে বল্।
.
খাবার টেবিল থেকে আমরা বাইরের ঘরে এসে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বাজে প্রায়।