বুঝলাম প্রেসিডেন্টের অবস্থানটা এখানকার মেম্বারদের কাছে কোনকিছু একটা গোপন ব্যাপার নয়। দুনম্বর দরজা দিয়ে যে প্রেসিডেন্টের ঘবে যাওয়া যায় তা এদের অজ্ঞাত নয়।
এমনি একটু দরকার ছিল। তুমি কতক্ষণ?
বলাই বাহুল্য, আমাদের উভয়ের মধ্যে আপনি পর্বটা ঘুচিয়ে দিয়ে উভয়ে আমরা পরস্পর পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতে শুরু করেছিলাম ইতিমধ্যে।
তোমার কিছুক্ষণ আগে মিস সেন প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে বের হয়ে এল দেখলাম। দুজনেই একসঙ্গেই গিয়েছিলে নাকি প্রেসিডেন্টের ঘরে?
না, উনি আগে গিয়েছিলেন, পরে আমি গিয়েছি।
কিন্তু দরকারটা হঠাৎ কি পড়ল তাঁর কাছে তোমার? ও-ঘরে তো বড় একটা কেউ পা-ই দেয় না এখানকার!
তাই নাকি?
হুঁ। তিন বছর এখানে যাতায়াত করছি, একদিন মাত্র ওঁর ঘরে গিয়েছিলাম। বাবাঃ,যা গম্ভীর লোকটা! কথা বলতেই ভয় করে।
কেন?
কেন আবার কি? মুখগোমড়া লোকদের দুচক্ষে আমি দেখতে পারি না। সে যাক। তুমি এ কদিন আসনি যে বড়?
কলকাতায় ছিলাম না।
আর আমার যে এ কদিন কি ভাবে কেটেছে! কণ্ঠে বিশাখার একটা চাপা অভিমানের সুর যেন জেগে ওঠে।
মনে মনে একটু শঙ্কিত হয়ে উঠি। শেষ পর্যন্ত এই বয়েসে কি সত্যিসত্যিই বিগত-যৌবনা, প্রেমপাগল এক বিধবা নারীর মনের মানুষ হয়ে উঠলাম নাকি!
নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য নেহাৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই কৌতুকভরে বিশাখাকে প্রশয় দিতে গিয়ে অন্য এক ভয়াবহ কৌতুকের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছি না তো!
বিশাখার মুখের দিকে তাকালাম একবার আড়চোখে। সুস্পষ্ট অনুরাগমাখা অভিমানের চিহ্ন দেখলাম সে মুখে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তে।
বেচারী বিশাখা চৌধুরী! পলাতকা যৌবনা-স্বপ্নের পিছনে পিছনে কি আশা নিয়েই না সে ছুটে বেড়াচ্ছে! হাসির চাইতে যেন দুঃখই হল। কারণ আমার নিজের দিকটা নিজের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। সেখানে কোথাও একটুকু কুয়াশাও নেই। এবং যেদিন ও স্পষ্ট করে জানতে পারবে সেই সত্যটি, সেদিনকার সে দুঃখটা বেচারী সইবে কেমন করে?
কিন্তু যাক গে সে কথা। যে কারণে আমার এখানে আসা সেদিক দিয়ে আমি যে এখনও এতটুকু অগ্রসর হতে পারিনি।
এখানকার সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও আমার কাছে ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট।
বিশাখার কথায় হঠাৎ আবার চকম ভাঙল, চল সত্য, নীচে যাওয়া যাক।
চল!
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে
পরের দিন সকালে কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে তার বসবার ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।
বৈকালী সঙ্ঘে. আমার কয়েক রাত্রির অভিজ্ঞতার কথা কিরীটীকে বলছিলাম এবং সে গভীর মনযোগের সঙ্গে শুনছিল। সব শুনে বললে, আমিও এ কদিন চুপ করে ছিলাম না। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর রাজেন সিকদারকে দিয়ে বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কে যতটা খোঁজ নেবার নিয়েছিলাম কিন্তু কোনরকম সন্দেহের ব্যাপারই তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিসের রিপোর্ট হচ্ছে বৈকালী সঙ্ঘটি তথাকথিত ধনী এবং উচ্চশ্রেণীর অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল নর-নারীর সম্পূর্ণ নির্দোষ মিলন-কেন্দ্র। একটু-আধটু নাচ-গান, ফ্ল্যাশ, বিলিয়ার্ড ও ড্রিঙ্ক চলে সেখানে যেমন আর দশটি ঐ ধরনের নৈশ-ক্লাবে চলে থাকে। এবং নর-নারীর অবাধ মেলামেশার ফলে যতটুকু প্রেমঘটিত আদিরসাত্মক ব্যাপার ঘটতে পারে তার বেশী কিছুই নয়। অর্থাৎ পুলিসের গোপন কালোখাতায় বৈকালী সঙ্ঘ নৈশ-ক্লাবটির নাম নেই।
কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি কিরীটী, ঠিক যতটুকু বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে সেটাই সব নয়। একেবারে নিদোষ নিরামিষ ব্যাপার সবটাই নয়।
অর্থাৎ তুই বলতে চাস,পুলিসের সতর্ক দৃষ্টির অলক্ষ্যে আরও একটা গোপন ব্যাপার সেখানে ঘটে যার আকর্ষণে বিশেষ একদল নরনারী সেখানে রাতের পর রাত ছুটে যায়!
হ্যাঁ। আর সেটা যে ঠিক কী হতে পারে সেটাই এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না। তোর মতের সঙ্গে যে আমার খুব একটা অমিল আছে তা নয় সুব্রত, কিন্তু তুই ও কৃষ্ণা যে পথে চলেছিস সে পথে গেলে কোনদিনই তোরা ঠিক জায়গাটিতে পৌঁছতে পারবি না।
মানে?
অর্থাৎ মাতালের আড্ডায় গেলে তোকেও তাদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে মদ খেয়ে ঢলাঢলি করতে হবে। নচেৎ কোনদিনই তাদের আপনার জন বলে তারা তোকে ভাববে না। মাঝখান থেকে শুধু খানিকটা পণ্ডশ্রমই হবে। অত দূর থেকে নয়, সত্যি করে প্রেম করতে হবে বিশাখা চৌধুরীর সঙ্গে তোর।
তার মানে?
মানে আবার কি! ওরকম প্রেমের অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি প্রেমে পড়তে হবে তোকে।
ওরে বাবা! ঐ বিশাখা চৌধুরীর সঙ্গে! ওটা তো একটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মেয়েমানুষ!
কিরীটী আমার কথায় মৃদু হাসে।
হাসছিস! বিশাখা চৌধুরীর পাল্লায় পড়লে বুঝতে পারতিস!
বিশাখার বয়স হয়ে গিয়েছে একটু বেশী, এই তো? আরও বছর পনের তার বয়স কম হলে, নিশ্চয়ই এমনি আপত্তিটা তোর করে অভিনয় করতিস না প্রেমের?
কখনও না।
নিশ্চয় তাই। আরে ভুলে যাস কেন, প্রেমের ব্যাপারটাই তো একটা হিস্টিরিয়া।
মানি না তোর কথা।
মানবি রে মানবি। আগে সত্যিকারের কারও প্রেমে পড়, তখন বুঝবি।
থাক, হয়েছে। এখন একটা কাজের কথা বল তো। বৈকালী সঙ্ঘের যাদের সম্পর্কে তোকে আমি বলেছি, তাদের সম্পর্কে তোর মতামতটা কি?
সকলেই তো দেখা যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।