হ্যাঁ।
আচ্ছা চলি, আজ একটু কাজ আছে। এবার থেকে আসা-যাওয়া যখন করবেন তখন পরিচয় আরও হবে। বলে সোজা দুনম্বর দরজা-পথে এগিয়ে গেল মিত্রা সেন।
কিন্তু সবে সে দরজা বরাবর গিয়েছে কৃষ্ণা অর্থাৎ মীনা তাকে বাধা দিয়ে বললে, কিন্তু আপনার নামটা তো জানা হল না!
মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াল মিত্রা সেন। মরালের মত হীরার কষ্ঠী পরা গ্রীবা বেঁকিয়ে তাকাল কৃষ্ণার দিকে। মৃদু কণ্ঠে শুধাল, আমার নাম?
হ্যাঁ। কৃষ্ণা জবাব দেয়। মিত্রা সেন। বলেই আর দাঁড়াল না, ওষ্ঠপ্রান্তে চকিত হাসির একটা বিদ্যুৎ জাগিয়ে দরজা ঠেলে হলঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল পরমুহূর্তেই।
সংগীতের আনন্দধ্বনির মাঝখানে মিত্রা সেনের আঁকস্মিক আবিভাবটা হলঘরের মধ্যে হঠাৎ যেন একটা থমথমে ভাবের সৃষ্টি করেছিল, মিত্রা সেনের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সেটা তখন কেটে গেল। সকলের কণ্ঠ হতে কৃষ্ণাকে আর একটি গান শোনানোর জন্য মিলিত অনুরোধ উচ্চারিত হল।
মীনা দেবী, আর একটি প্লিজ! কৃষ্ণা সবার অলক্ষ্যে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। বুঝলাম আমার ছদ্মবেশে আমাকে চিনতে না পারলেও কণ্ঠস্বরে ধরতে পেরেছে সে আমাকে। চোখের ইঙ্গিতে জানালাম—গাও।
আবার একটি গান ধরল কৃষ্ণা। সুধীও তার বেহালা ধরল সেই গানের সুরে সুর মিলিয়ে।
এই সুযোগ।
সকলেরই দৃষ্টি কৃষ্ণার উপরে।
আমি সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে দুনম্বর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল, আমি হলঘর থেকে বের হলাম।
দরজা ঠেলে হলঘর থেকে যেখানে গিয়ে প্রবেশ করলাম সেটা একটি ছোট আকারের ঘর। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। এদিন-ওদিক গোটা দুই সোফা-সেটি রাখা।
কিন্তু ঘরের চারদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম। একটি দরজা বা জানালা আমার নজরে পড়ল না।
নজরে যা পড়ল তা হচ্ছে ঘরের চার দেওয়ালে চারদিকে আঁকা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মানুষপ্রমাণ সাইজের বিভিন্ন বেশভূষার চারটি ওরিয়েন্টাল নারীমূর্তি।
ক্ষণপূর্বে হলঘর থেকে মিত্রা সেন এই ঘরেই ঢুকেছে। তবে সে গেল কোথায়! এই ঘরে সে নেই তো! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তবে কি এ ঘরে কোন গুপ্ত দ্বারপথ আছে, যে দ্বারপথে মিত্রা সেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে!
নিশ্চয়ই তাই। নইলে সে যাবে কোথায়?
কিন্তু কোথায় সে গুপ্ত দ্বারপথ এই ঘরে, যদি থেকে থাকেই?
এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে আবার আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি চার দেওয়ালে অঙ্কিত চারটি নারীমূর্তির প্রতি নিবদ্ধ হল।
সেই ছবিগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চকিতে একটা কথা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল। এই ছবিগুলোর মধ্যেই কোন গুপ্ত দ্বারপথে সংকেত লুক্কায়িত নেই তো! ভাবতে ভাবতে আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিগুলো দেখতে শুরু করলাম, একটার পর একটা।
তৃতীয় ছবিখানির সামনে এসে দেখতে দেখতে হঠাৎ ছবিটার মধ্যে একটা জিনিস.আমার নজরে পড়ল। অপরূপ নৃত্যভঙ্গিতে লীলায়িত নারীদেহের দক্ষিণ হস্তে একটি পদ্মকুঁড়ি ধরা। এবং পদ্মকুঁড়িটি মনে হল ছবির অন্যান্য অংশের মত আঁকা নয়। যেন ডাইসের সাহায্যে গড়ে তোলা। হাত বাড়িয়ে পদ্মকুঁড়িটা দেখতে দেখতে একসময় চমকে উঠলাম সম্পূর্ণ ছবিটাই ধীরে ধীরে ঘুরে গেল যেন একটা পিভেটের উপরে। আর আমার সামনে প্রকাশ পেল অ-প্রশস্ত একটি মৃদু আলোকিত প্যাসেজ।
মুহূর্তকাল মাত্র দ্বিধা করে সেই প্যাসেজের মধ্যে পা দিলাম। কয়েক পদ এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে প্যাসেজটা। আর মোড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্মুখে আমার চোখে পড়ল একটি ভেজানো ঈষৎ-উন্মুক্ত কাঁচের দরজা।
দরজার উপরে বাইরে ঝুলছে দু-পাশে ভারী ভেলভেটের পদা।
পর্দার আড়ালে গিয়ে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিতে যাব—মিত্রা সেনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।
মিত্রা সেন যেন কাকে বলছে, তা যেন হল, কিন্তু ঐ কুমারী মীনা রায়ের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়টা কি?
তুমি তো জান মিত্রা, স্পষ্ট পুরুষকণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল, এ সঙ্ঘের নিয়ম, তিনজন মেম্বার যখন কাউকে মেম্বারশিপের জন্য রেকমেন্ড করে দলভুক্ত হবার পারমিশন দেয় তখন আর তার সম্পর্কে কোন কৌতূহলই কারও প্রকাশ করা চলবে না।
হ্যাঁ, তা জানি বৈকি। কিন্তু ইদানীং দেখছি বৈকালী সঙ্ঘের নিত্যনতুন মেম্বার হচ্ছে।
পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন হল, কি বলতে চাও তুমি?
কি আমি বলতে চাই, প্রেসিডেন্টের নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
মিস্ সেন কি প্রেসিডেন্টের কাছে কৈফিয়ত তলব করছেন? তাহলে আবার আপনাকে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই স্মরণ করতে বলব এখানকার এগার নম্বর আইনটি। আচ্ছা মিস্ সেন, এবারে তাহলে আপনি যেতে পারেন।
বুঝলাম মিস্ সেন এবারে এখুনি ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। আমি চকিতে দরজার পদার আড়ালে নিজেকে যথাসম্ভব গোপন করলাম, কেননা তখন সেখান থেকে আর পালাবার সময় ছিল না। এবং অনুমান আমার মিথ্যা নয়, পরমুহূর্তেই জুতোর খটখট শব্দ তুলে ঘর থেকে বের হয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা প্যাসেজে অদৃশ্য হয়ে গেল মিত্রা সেন।
ভাবছি আমিও এবারে স্থানত্যাগ করব, কিন্তু হঠাৎ একটা বিচিত্র কঁ-কঁ শব্দে চমকে উঠলাম।
তারপরই ঘরের সেই পূর্ব-পুরুষকণ্ঠ আবার শোনা গেল: মীরজুমলা, কি খবর! অ্যাঁ? হ্যাঁ– হ্যাঁ, ঠিক আছে। O.K.
আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিবেচনার কাজ হবে না। নিঃশব্দে পায়ে আমি যে পথে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই পূর্বেকার ঘরে প্রবেশ করলাম। সেখান থেকে আবার হলঘরে গিয়ে প্রবেশ করতেই বিশাখা এগিয়ে এল আমার দিকে। প্রশ্ন করল, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে যে হঠাৎ?