চোখের নিচেই নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো যেন একটু বেঁকে রয়েছে সামনের দিকে।
গালের দু-পাশে হনু দুটি একটু বেশিমাত্রায় সজাগ, অনেকটা ব-দ্বীপের মত। অতিরিক্ত মাত্রায় ধূমপানের ফলে পুরু ওষ্ঠ দুটিতে একটা পোড়া তামাটে রঙ ধরেছে, আর তারই মধ্যে
মধ্যে কলঙ্কের মত ছোট ছোট খেতচিহ্ন। চিবুকটা একটু ভোঁতা এবং ঠিক মধ্যিখানে পড়েছে একটা খাঁজ।
আরও একটা বিশেষত্ব আছে মুখটার মধ্যে। প্রশস্ত কপালের ডানদিকে একেবারে প্রান্ত ছুঁয়ে আধ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা একটা রক্তজড়ুল চিহ্ন। সেই জড়ুলের উপরেও দুটি দীর্ঘ কেশ।
মাথায় অত্যন্ত ঘন কর্কশ কুঞ্চিত কেশ অনেকটা নিগ্রোদের মত, ব্যাকব্রাস করা।
লম্বা হাড়গিলে প্যাটার্ণের ডিগডিগে চেহারা। সরু লম্বা গলা। কণ্ঠা ও চিবুকের মধ্যবর্তী গলনলীর উপরে অ্যাডমস্আপেলটা যেন একটু বেশী প্রকট। ইংরাজীতে যাকে বলে প্রমিনেন্ট।
নিখুঁতভাবে দাড়িগোঁফ কামানো। মধ্যে মধ্যে লোকটির সূচাগ্র জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়া যেন একটা বদভ্যাস। সব কিছু জড়িয়ে মনে হয় যেন একটা বিষধর সরীসৃপ ফণা বিস্তার করে হেলে আছে। এই বুঝি ছোবল দেবে। ভুজঙ্গ নামটা সার্থক সেদিক দিয়ে। এবং চেহারায় সরীসৃপ-সাদৃশ্যটা যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চাপা নিঃশব্দ হাসির মধ্যে। ডাক্তারের সদাসর্বদা জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়ার মত আর একটি অভ্যাস যা প্রথম দৃষ্টিতেই আমার নজরে পড়েছিল, সেটা হচ্ছে তাঁর হাসি। বলতে গেলে কথায় কথায় যেন তিনি হাসেন এবং হাসির সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিচের শ্বেতিচিহুিত পুরু তাম্রাভ ওষ্ঠটা নিচের দিকে নেমে আসে উল্টে আর উপরের ওষ্ঠটি সামান্য একটু উপরের দিকে কুঁচকে ওঠে। আর বিভক্ত সেই ওযুগলের ফাঁকে সজারুর মত ছোট ছোট তীক্ষ্ণ দুসারি অদ্ভুত রকমের সাদা সাদা দাঁত একঝাঁক তীরের ফলার মত যেন মুহূর্তের জন্য সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝিকিয়ে ওঠে। এবং অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে নিকোটিননিষিক্ত মাড়িটা যেন ঠেলে ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। ঐ সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হয়েছিল, যে লোক অতবেশী ধূমপান করে তার মাড়ির সঙ্গে দাঁতেও নিকোটিনের কালচে দাগ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু দাঁতগুলো যেন মুক্তার মতই ঝকঝক করছিল।
যাহোক, বলছিলাম ভুজঙ্গ ডাক্তারের হাসির কথা। ভুজঙ্গ ডাক্তার হাসলে এবং সেই সময় তার দিকে চেয়ে থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সে মুখের উপর থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিতে হবেই। ঘিনঘিন করে উঠবে সমস্ত মনটা। হঠাৎ গায়ে একটা টিকটিকি পড়লে যেমন অজান্তেই সর্বাঙ্গ সিসিরিয়ে ঘিনঘিন করে ওঠে, ঠিক তেমনি। কিন্তু আশ্চর্য! পরক্ষণেই ডাক্তারের কণ্ঠস্বর কানে গেলেই পুনরায় তার দিকে চোখ ফিরিয়ে না তাকিয়ে উপায় নেই। পুরুষোচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু যেমন সুরেলা তেমনি মিষ্টি। মনে হবে কথা তো নয় যেন গান গাইছে লোকটা। আর কথা বলার ভঙ্গিটিও এমন চমৎকার! শুধু কি কথাই? ব্যবহারটুকুও যেমনি মিষ্টি মোলায়েম তেমনি দরদেরও যেন অন্ত নেই।
শিক্ষায় দীক্ষায় রুচিতে ব্যবহারে কথায়বাতায় সৌজন্যতায় এমন কি আগাগোড়া পরিচ্ছন্ন রুচিসম্মত বেশভূষায় পর্যন্ত যেন একটা অদ্ভুত ঝকঝকে শালীনতা ও আভিজাত্য সুস্পষ্ট। তাই বলছিলাম নাম ও চেহারার সামঞ্জস্যের মধ্যে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য।
সামান্য আলাপেই যেন লোকটির একেবারে নিঃস্ব পর একান্ত অপরিচিতকেও মুহূর্তে আকর্ষণ করে আপনার করে নেবার আশ্চর্য রকমের একটা ক্ষমতা আছে।
চোখের উপরে যেন এখনও ভাসছে লোকটার চেহারাটা।
পরিধানে দামী পাতলা ট্রপিক্যাল অ্যাস কলারের ক্রীজ করা সুট। গলায় সাদা কলারের সঙ্গে কালোর উপরে লাল স্পটেড বো, পায়ে দামী গ্লেসকীডের চকচকে ক্রেপসোলের জুতো।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. বি. এফ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)। কলকাতা শহরে বছর দশেক হবে প্র্যাকটিস করছেন। সরকারী হা তালের সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যেই শহরের অগ্রগণ্য চিকিৎসকদের তালিকার মধ্যে অন্য কজন বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন।
প্রতিপত্তি ও পসারে বেশ কায়েমী ভাবেহ ২..ছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। লোকেরা বলে ভুজঙ্গ ডাক্তার মরা মানুষকেও নাকি বাঁচিয়ে তুলতে পারে এমনই পারঙ্গম চিকিৎসাশাস্ত্রে।
সাজারী প্র্যাকটিস করেন ভুজঙ্গ ডাক্তার। সর্বরোগের চিকিৎসক নন। সাজারীর যে-কোন কঠিন রোগীর ঘরে ভুজঙ্গ ডাক্তার পা দিলেই নাকি লোকেরা বলাবলি করে, তার অর্ধেক রোগ সেরে যায়। এমনি অচল বিশ্বাস ও আস্থা সকলের ভুজঙ্গ ডাক্তারের উপরে বর্তমান।
পার্কসাকাস অঞ্চলে তিনতলা একটা বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার চারঘরওলা একটা সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট নিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তারের কনসালটিং চেম্বার ও নার্সিংহোম। একজন জুনিয়ার ডাক্তার অ্যাসিস্টেন্ট ও চারজন শিক্ষিতা ট্রেণ্ড নার্স। দুজন ইউরোপীয়ান, একজন অ্যাংলো-চায়নীজ, একজন বাঙালী। চেম্বারের সঙ্গে সংলগ্ন চার-বেডের নার্সিংহোমটির সঙ্গেই লাগোয়া একটি অপারেশন থিয়েটারও আছে।
চেম্বারের কনসালটিং আওয়ার প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা। আবার সন্ধ্যায় পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা।