পঞ্চম রাত্রে হঠাৎ চমকে উঠলাম আর এক নবাগতার মুখের দিকে তাকিয়ে। পঞ্চম রাত্রি অবিশ্যি আমার পর পর আসা নয়। বৈকালী সঙ্ঘে আমার পঞ্চম রাত্রি আসা গত কুড়িদিনে। আজ আবার দ্বিতীয়বার রাজেশ্বর চক্রবর্তীকে দেখলাম বৈকালী সঙ্ঘে।
ইতিমধ্যে আর তাঁকে দেখতে পাইনি।
নিয়মানুযায়ী আজও প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীই এক নবাগতাকে সঙ্ঘের অন্যান্য মেম্বারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
কুমারী মীনা রায়।
আমি চমকে উঠেছিলাম কুমারী মীনা রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এইজন্য যে প্রথম দৃষ্টিতেই একটু ভাল করে লক্ষ্য করতেই তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কৃষ্ণা বৌদি। কিরীটী-মহিষী।
এমনিতেই চোখ-ঝলসানো রূপ আর চেহারা কৃষ্ণার। তার উপরে আজ তার বেশ ও প্রসাধনে একটা অভূতপূর্ব চাকচিক্য ছিল, যাতে করে পুরুষ তো ছার মেয়েদেরও মনে আকর্ষণ জাগায়। এবং সেই কারণেই বোধ হয় সেরাত্রে আমার আবির্ভাবে কেউ আমার দিকে ফিরে না তাকালেও, আজ ঘরের মধ্যে উপস্থিত পনেরজন বিভিন্ন বয়েসী নরনারীর ত্রিশজোড়া কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি যেন একঝাঁক ধারালো তীরের মতই কৃষ্ণাকে গিয়ে তার সর্বাঙ্গে বিদ্ধ করল। এবং তাকিয়েই রইল সকলে।
মনে হচ্ছিল আজ রাত্রে বৈকালী সঙ্ঘের মক্ষীরানী শ্রীমতী মিত্রা সেন এসে তার পাশে দাঁড়ালেও বুঝি ম্লান হয়ে যেতেন। কিন্তু মিত্রা সেন সে-সময়ে এসে তখনও পৌঁছাননি। যদিও সেটা শনিবারই ছিল।
প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীতাঁর কর্তব্য-কাজটুকু সম্পাদন করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
এবং নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত কৃষ্ণার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
০৭. নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত
নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্তর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলাম। হায় অবোধ, জান না তো ও বহ্নিশিখা মিথ্যা, শুধু মরীচিকা, মায়া মাত্র! ও তোমাদের বুকে তৃষ্ণার আগুন জ্বালিয়ে পালিয়েই যাবে। কোনদিনই ওর নাগাল পাবে না।
হঠাৎ এমন সময় বেহালার বাক্স হাতে সুধীরঞ্জন এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এবং সুধীকে দেখেই জাস্টিস মল্লিকের মেয়ে মিস রমা মল্লিক মধুর কন্ঠে সুধীকে সম্বোধন করে বলে উঠলেন, আসুন সুধীবাবু! অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম। কিন্তু ভায়োলিনের বাক্স আপনার হাতে, ব্যাপার কি?
জবাব দিলেন বিশাখা আমার পাশ থেকে, হ্যাঁ, ওটা ভায়োলিনই। মৃদুলা দেবীকে উনি যে আজকাল ভায়োলিন শেখান। কিন্তু সরি সুধীবাবু, আজ মৃদুলা অ্যাবসেন্ট। আর রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল যখন, আজ আর কি আসবেন!
জবাব দিলেন রমা মল্লিক, নাই বা এল মৃদুলা! আজ সুধীবাবুর বাজনা আমরা শুনব। সুধীবাবু, please–একটা বাজিয়ে শোনান!
সোমশ্বর রাহাও মিস্ মল্লিকের অনুরোধে সায় দিলেন।
সুধী হাসতে হাসতে বললে, আমি রাজী আছি, একটি শর্তে; আপনাদের মধ্যে কেউ must accompany me with your voice!
জবাব দিলেন এবারে মিস্ মল্লিক, কিন্তু কে গলা দেবে বলুন তো? মিত্রাদি absent যে! এখনও এসেই পোঁছোননি!
কেন? মিস্ সেন নেই বলে কি আর কেউ আমাকে আপনাদের মধ্যে একটু সঙ্গ দিতে পারেন না?
এবারে বললাম আমিই, মিস্ মীনা দেবী, আপনার মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি অন্তত আমাদের নিরাশ করবেন না!
কৃষ্ণা সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি?
হ্যাঁ, আপনি। আমার ধারণা নিশ্চয় আপনি গান জানেন।
সামান্য একটু-আধটু: কিন্তু আপনাদের কি তা ভাল লাগবে? বেশ গাইছি, পরে কিন্তু শুনে নিন্দে করতে পারবেন না।
সুধীরঞ্জন বেহালাটা বাক্স থেকে বের করে সুর বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললে, ধরুন,…
কি গাইব? কৃষ্ণা শুধায়।
যা খুশি। সুধী বলে।
কৃষ্ণা তখন গান ধরল। রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর সুধী মেলাল সেই সুরে তার বেহালা।
নির্বাক। স্তব্ধ সমস্ত হলঘর!
সকলের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় ও শ্রদ্ধা। বুঝলাম কৃষ্ণা দেবী তাঁর প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই বৈকালী সঙ্ঘকে জয় করলেন তাঁর রূপ ও কণ্ঠ দিয়ে। গানের শেষ লাইনে এসে সবে পৌঁছেছে কৃষ্ণা, হলঘরে আবিভাব ঘটল মিতা সেনের।
ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণার কণ্ঠের সংগীত শুনে মিত্রা সেন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এবং তার সে দাঁড়াবার মধ্যে যতটা কৌতূহল তার চাইতেও বেশি বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, আর কেউ ঘরের মধ্যে সেটা বুঝতে না পারলেও আমার সতর্ক দৃষ্টিতে কিন্তু সেটা এড়ায়নি।
এবং তার সে বিস্ময় আরও বৃদ্ধি পেল যখন কৃষ্ণার গানের শেষে ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সকলের কণ্ঠ হতে অকুণ্ঠ প্রশংসাধ্বনি উচ্ছ্বসিত হয়ে কৃষ্ণাকে অভিনন্দন জানাল।
সুপার্ব! একসেলেন্ট! চমৎকার! প্রভৃতি অভিনন্দন চারিদিক হতে শোনা গেল।
ঐ সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি মিত্রা সেনের উপরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু আজ আর বিশেষ কারও কণ্ঠ হতে পূর্ব পূর্ব রাত্রের মত তার আবির্ভাবে স্বাগত সম্ভাষণ উচ্চারিত হল না।
মৃদু কণ্ঠে দু-একজন মাত্র বললে, গুড ইভনিং মিস্ সেন।
অকস্মাৎ যেন এক মর্মান্তিক আঘাতে মিত্রা সেনের ঐ সঙ্গে এতদিনকার সুনির্দিষ্ট আসন ভেঙে পড়ছে। মিত্রা সেন তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবাগতা কৃষ্ণার দিকে। তার দুচোখের দৃষ্টিতে শুধু যে বিস্ময় তাই নয়, সেই সঙ্গে একটা চাপা বিরক্তি ও তাচ্ছিল্যও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমি মিত্রা সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম এত বড় আঘাত কোন নারীর পক্ষে সহ্য করা সত্যই অসম্ভব। বিশেষ করে মিত্রা সেনের মত নারী, যে এতকাল এখানকার সকলের হৃদয়ে বিজয়িনীর আসন অধিকার করে এসেছে এবং কখনও অনুকম্পা, কখনও সামান্য একটু সহানুভূতি বা একটুখানি প্রশ্রয়ের কৃপা-দৃষ্টি বর্ষণ করে এখানকার অনেকেরই হৃদয় নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলে এসেছে, তার পক্ষে তো আরও দুঃসাধ্য। কিন্তু দেখলাম মিত্রা সেন শুধু এতকাল এতগুলো লোককে রাতের পর রাত রূপের কাজল দিয়েই মোহগ্রস্ত করে রাখেনি, বুদ্ধিও যথেষ্টই রাখে সে। মুহূর্তের মধ্যেই নিজের পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করে নিয়ে ওষ্ঠপ্রান্তে তার চিরাচরিত স্বভাবসিদ্ধ বিজয়িনীর হাসি ফুটিয়ে অকুণ্ঠ চরণে কৃষ্ণার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললে, নমস্কার! আপনি বোধ হয় কুমারী মীনা রায়—বৈকালী সঙ্ঘের নতুন মেম্বার!