হঠাৎ বিশাখার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, কেমন লাগছে এ জায়গাটা, সত্যসিন্ধুবাবু?
অ্যাঁ!
কি ভাবছিলেন বলুন তো?
কই, কিছু না।
একটা কথা বলব, মিঃ রায়?
বলুন না।
সত্যসিন্ধু! আপনার নামটা যেন কেমন!
কেন বলুন তো?
সে জানি না, তবে ও নামে আমি কিন্তু আপনাকে ডাকতে পারব না।
সে কি! তবে কি নামে ডাকবেন?
কেন? ঐ পোশাকী নামটা ছাড়া আপনার কি আর অন্য কোন নাম নেই? মানুষের তো কত সময় ডাকনামও দু-একটা থাকে!
ডাকনাম?
হ্যাঁ। এই ধরুন না, যেমন আমার ডাকনাম শিলু। এখন অবিশ্যি ও নামে ডাকবার আর কেউ নেই। তবে ছোটবেলায় ঐ নামটা ধরেই সকলে আমাকে ডাকত। বলুন না, আপনার ডাকনামটা কি?
ঐ নামটি ছাড়া তো আমার আর দ্বিতীয় কোন নাম নেই বিশাখা দেবী। তবে ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে সত্যবাবু বলেও ডাকতে পারেন।
কারা যেন এদিকে আসছে!
সত্যিই চেয়ে দেখি একটি পুরুষ ও একটি নারী-মূর্তি পরস্পর গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে মন্থর পদে হাঁটতে হাঁটতে এই দিকেই আসছে।
অস্পষ্ট আলোয় তাদের মুখ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
চলুন ঐ ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চ আছে, সেখানে গিয়ে আমরা বসি।
রেডিয়াম ডায়েল দেওয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। বললাম, এবারে যাব ভাবছি!
কোথায়?
বাড়িতে।
বাড়িতে বুঝি রাত জেগে বসে আছেন মিসেস?
মৃদু হাসলাম বিশাখার কথায়।
হাসলেন যে? প্রশ্ন করলেন বিশাখা।
আপনার কথায়।
কেন?
তার কারণ বিয়েই করিনি তো মিসেসের ভাগ্য আসবে কোথা থেকে?
সে কি! বাঙালীর ছেলে, এত উপার্জন, এখনও বিয়ে করেননি?
না।
আশ্চর্য! কেন বলুন তো?
কেন আর কি! সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
বিয়ে করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি?
না। তাছাড়া শুধু সুযোগই তো নয়, মনের একটা তাগিদও তত থাকা দরকার বিয়ের ব্যাপারে।
ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে আমরা দুজনে এসে বিশাখা-বর্ণিত ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চের উপরে পাশাপাশি বসেছিলাম।
বাড়িতে মিসেসের তাগিদই যখন নেই তখন বাড়ি ফেরবার জন্য এত তাড়াই বা কিসের?
রাত হল।
নিজের ছোট্ট হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিয়ে বিশাখা এবারে বললেন, মাত্র তো এগারটা! রাতের তো এখনও সবটাই বাকি!
হঠাৎ এমন সময় কানে এল মৃদু ভায়োলিন বাজনার শব্দ।
আশেপাশে কে যেন ভায়োলিন বাজাচ্ছে মনে হচ্ছে? প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ।
কে বাজাচ্ছে বলুন তো?
সুধী বাজাচ্ছে।
সুধী!
মানে সুধীরঞ্জন?
হ্যাঁ। চেনে নাকি তাকে?
হ্যাঁ। আপনাদের এখানকার সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে ঐ একজনের সঙ্গেই যা একটু-আধটু পূর্ব-পরিচয় আছে।
সিনিক!
কে?
কে আবার, আপনার ঐ সুধীরঞ্জন!
কেন?
কিন্তু আমার কেনর জবাব দিলেন না বিশাখা। চুপ করে রইলেন। সেরাত্রে বুঝতে পারলেও পরে বুঝছিলাম সুধীরঞ্জনকে কেন বিশাখা চৌধুরী সেরাত্রে সিনিক বলেছিলেন! যাহোক বিশাখার আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অনিচ্ছাটা বুঝতে পেরে আমিও অন্য প্রশ্ন তুললাম। বললাম, এখানে এসে সুধী কারও সঙ্গে বুঝি মেশে না? আপনার মনে একা একা বেহালা বাজায়? তা বেহালা বাজাবার জন্য এখানেই বা ওকে আসতে হবে কেন তাও তো বুঝতে পারছি না!
কে বললে সুধী এখানে বেহালা বাজাতে আসে? ও বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে!
বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে? এই অন্ধকার বাগানের মধ্যে?
মনের মানুষকে বেহালা বাজানো শেখাবার জন্যে আলো বা আঁধারের ঘর বা বাগানের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে নাকি?
মনের মানুষ!
হ্যাঁ। শনিবার রাত্রে ও আসে মৃদুলোকে বেহালা শেখাবার জন্যে।
আর কৌতূহল প্রকাশ করা হয়ত উচিত হবে না। তাই চুপ করে গেলাম। মৃদু শব্দে বেহালা বাজালেও এমন চমৎকার সুরের একটা আকৃতি সে বাজনার মধ্যে ছিল যা আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্বভাবতই সেইদিন আকর্ষণ করছিল।
রাত হয়ে যাচ্ছে, তবু যাবার কথাও যেন ভুলে গেলাম।
সুধী এত চমৎকার বেহালা বাজায়, কই আগে তো কখনও জানতে পারিনি!
হঠাৎ আবার চমক ভাঙল বিশাখার কণ্ঠস্বর, চলুন সত্যসিন্ধুবাবু, উঠুন।
উঠব?
হ্যাঁ। এই যে বলছিলেন রাত হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি যাবেন? যাবেন না?
হ্যাঁ চলুন।
উঠে দাঁড়ালাম।
.
আরও তিন রাত্রি বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত করবার পর বিশাখা চৌধুরীর পরিচয় আর একটু পেলাম।
ফিলসফির বিখ্যাত প্রফেসর স্বর্গীয় ডক্টর প্রতুল চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী হচ্ছেন বিশাখা চৌধুরী। বয়স পঁয়তাল্লিশোত্তীর্ণ।
দুটি মেয়ে, তাদের দুজনেরই বিবাহ হয়ে গিয়েছে। তারা শশুর-গৃহে। ডক্টর চৌধুরী নেহাত কিছু কম রেখে যাননি তাঁর বিধবা স্ত্রীর জন্য। কলকাতার উপর একখানা বাড়ি ও মোটামুটি কিছু ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও শেয়ারের কাগজ।
ইচ্ছা করলে বিশাখা চৌধুরী তাঁর বাকি জীবনটা আরামেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু গত-যৌবনা, দুটি সন্তানের জননী বিশাখার মনে কামনার আগুন তখনও নিঃশেষে নির্বাপিত হয়নি। তাই তাঁকে ছুটে আসতে হয়েছিল ঘরের বাইরে, বৈকালী সঙ্ঘের রাতের আসরে। প্রতি রাতে বৈকালী সঙ্ঘে তিনি আসতেন সেই অতৃপ্ত কামনার তাগিদেই। এবং সামনে যাকে পেতেন তাকেই আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করতেন। তিন রাত্রের আলাপেই সেটা আমার আর জানতে বাকি ছিল না। কিন্তু সে কথা জানতে পারা সত্ত্বেও আমি তাঁকে নিরুৎসাহ করিনি, কারণ তখন তাঁকে ঘিরে অন্য একটা চিন্তা আমার মনের মধ্যে উদয় হয়েছে। ওঁকে হাতে রাখতে পারলে এখানে আমি কতকটা নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়েই আসা-যাওয়া করতে যে পারব তা বুঝেছিলাম।