কিন্তু নিজের কাছেই নিজের আমার যেন কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। কেমন যেন একটু বিব্রত বোধ করছিলাম।
প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কেউ আমার কাছে এগিয়ে এল না।
আর আলাপ করবার চেষ্টাও করল না।
এখানকার নিয়ম-কানুন রীতি-নীতিও আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। গায়ে পড়ে এখানে হয়ত কেউ কারও সঙ্গে আলাপ করে না।
কিন্তু কিসের টানেই বা প্রতি রাত্রে এখানে এতগুলো বিভিন্ন চরিত্রের লোক এসে জড়ো হয়? সামান্য একটু তাস খেলা বিলিয়ার্ড খেলা বা সামান্য একটু ড্রিঙ্কের জন্যই কি? মন কিন্তু কথাটা মেনে নিতে চাইল না অত সহজে।
কিরীটী যে বলেছিল এবং সুধীরঞ্জনের কথাবার্তাতেও প্রকাশ পেয়েছিল,এ সঙ্ঘটা হচ্ছে আসলে নর-নারীদের একটা যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে পরস্পরের একটা মিলনকেন্দ্র, কই সেরকমও তো এতক্ষণের মধ্যে তেমন কিছু আমার চোখে পড়ল না। বরং রুচি ও সংযমের পরিচ্ছন্নতাই সকলের মধ্যে লক্ষ্য করছি এযাবৎ।
তাছাড়া পুলিস বা তৎ-সংক্রান্ত লোকেদের এড়িয়ে চলবার মত কিছুও তো এখনও পর্যন্ত আমার নজরে পড়ল না।
ভুলেই গিয়েছিলাম যে গ্লাসটা হাতে করেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটি সিপ-ও দিইনি পানীয়ে।
হঠাৎ পাশ থেকে একটি মিষ্ট মৃদু-উচ্চারিত নারীকণ্ঠে চমকে ফিরে তাকালাম।
কি নাম আপনার?
সুবেশা মধ্যবয়সী এক নারী ইতিমধ্যে কখন আমার পশ্চাতে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি। আমি যখন এ ঘরে প্রবেশ করি তখন ওঁকে দেখিনি। নিশ্চয়ই পরে কোন এক সময় এসেছেন।
আগন্তুক মহিলা খুব সুন্দরী না হলেও প্রসাধন-নৈপুণ্যে সুন্দরীই মনে হচ্ছিল। মৃদুকণ্ঠে আমার ছদ্মনামটা উচ্চারণ করলাম, সত্যসিন্ধু রায়।
আমার নাম বিশাখা চৌধুরী। আপনাকে আগে কখনও দেখিনি তো বৈকালী সঙ্ঘে?
না। আজই প্রথম এসেছি।
কারও সঙ্গে বুঝি এখনও আলাপ হয়নি?
নামেমাত্র কারও কারও সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে, তার বেশি হয়নি।
তা এখানে এই ঘরের মধ্যে রয়েছেন কেন? আমার তো বদ্ধ ঘরে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।
উপায় কি? কোথায় আর যাব?
কেন, গার্ডেনে চলুন না! Its a lovely place!
গার্ডেন!
হ্যাঁ। ও, আপনি তো নতুন! এ বাড়ির কিছুই জানেন না! চলুন গার্ডেনে যাওয়া যাক।
বেশ তো, চলুন।
বিশাখা চৌধুরীকে অনুসরণ করে তিন নম্বর দরজার দিকে এগিয়ে চললাম। দরজা ঠেলে প্রথমে তিনি বের হলেন, তাঁর পিছনে আমিও হলঘর থেকে বের হলাম। সরু একটা প্যাসেজ। স্বল্পশক্তির একটামাত্র বিদ্যুৎবাতির আলো প্যাসেজে। এবং সেই স্বল্পালোকে নির্জন প্যাসেজটা যেন কেমন থমথমে মনে হয়। প্যাসেজের দু-পাশে গোটা দুই বন্ধ দরজা আর একটা জানলা পার হয়ে দ্বিতীয় জানলার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চমকে উঠলাম। খোলা জানলার পথে স্বল্প আলো-আঁধারিতে মনে হল যেন একখানা মুখ চট করে সরে গেল। এবং শুধু মুখই নয়, একজোড়া চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
যে মুখখানা ক্ষণেকের জন্য আমার দৃষ্টিপথে পড়েছিল, পলকমাত্রেই সে মুখখানা কিন্তু চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। ওয়েটার মীরজুমলার মুখ।
চোখের তারায় সেই সরীসৃপ চাউনি। বুঝলাম নতুন আগন্তুক আমি এ গৃহে এবং আমাকে তিনজন মেম্বারের সুপারিশে এখানে প্রবেশাধিকার দিলেও প্রখর দৃষ্টিই আছে আমার উপরে।
এমনি নিছক কৌতূহলেই সেই প্রখর দৃষ্টি আমার উপর পতিত হয়েছে, না আমাকে সন্দেহ করেই এরা আমার প্রতি দৃষ্টি রেখেছে সেটাই বুঝতে পারলাম না। সে যাই হোক, বুঝলাম সাবধানের মার নেই, আমাকে এখানে সতর্ক ও সজাগ হয়ে চলতে হবে।
প্যাসেজটা শেষ হয়েছে একটা দরজায়। সে দরজাটা খুলতেই বিদ্যুতালোকে আমার চোখে পড়ল একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নীচে নেমে গিয়েছে।
আসুন! বিশাখা সিঁড়ির ধাপে পা দিলেন।
আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই চোখে পড়ল একটি উদ্যান। নানা আকারের গাছপালাই নজরে পড়ল। আরও নজরে পড়ল উদ্যানের মধ্যে স্বল্পশক্তির নীল বিদ্যুবাতি জ্বলছে মধ্যে মধ্যে। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো ছোট ছোট ঝোপের মতও আছে। আর আছে একটা ঘর উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে। লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে নেমে বিশাখার সঙ্গে উদ্যানে এসে দাঁড়ালাম।
ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে যেন একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ দিয়ে গেল। সরু সরু সিমেন্ট-বাঁধানো রাস্তা উদ্যানের মধ্যস্থলে একটি গোলাকার বাঁধানো জায়গা থেকে যেন চারিদিকে হাত বাড়িয়েছে। বাঁধানো রাস্তার পরেই ঘাসের কোমল সবুজ কার্পেট যেন চারিদিকে বিছানো। তার মধ্যে মধ্যে সযত্ন-বর্ধিত নানা আকারের গাছপালা ও ঝোপ। সব কিছুর ভিতরেই যেন একটা সুপরিকল্পিত প্ল্যানের নির্দেশ আছে বলে মনে হয়।
উদ্যানটি যে কতখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত সঠিক বোঝবার উপায় নেই। কারণ সীমানা সেই স্বল্প নীলাভ আলোয় রাত্রে চোখে পড়ল না।
আবছা আলো-ছায়ার মধ্যে দিয়ে সরু বাঁধানো পথ ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়েই ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছিলাম। আমার সঙ্গিনীর মনে তখন কি চিন্তা ছিল জানি না, কিন্তু আমার মনের সবটা জুড়েই সরু প্যাসেজ দিয়ে আসবার সময় ক্ষণেকের জন্য দেখা জানলা-পথে মীরজুমলার সেই পাথরে-খোদাইকরা মুখ ও সরীসৃপের মত দুটি চোখের দৃষ্টিভেসে বেড়াচ্ছিল। আমার সমস্ত চিন্তা যেন তাতেই নিবদ্ধ ছিল।