ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মিত্রা সেনকে সাদর আহ্বান জানালেও এবং সকলেইসোৎসুক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মিত্রা সেন কিন্তু সকলকেই উপেক্ষা করে তাকাল তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায়ের দিকে। মধুর হাসিতে দু-গালে তার টোল খেয়ে গেল। মৃদু কণ্ঠে অশোকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বললে, অশোক, আমার আসতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল!
দরদে ও আব্দারে মেশানো সে কণ্ঠের সুর।
অশোক রায়ের ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটুখানি হাসি জেগে ওঠে।
তারপরেই অশোকের কাছে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে এসে বললে, পূবের চাইতে যেন আর একটু চাপা কণ্ঠেই, রাগ করনি তো?
অন্য কেউ না শুনলেও কথাটা আমি শুনতে পেলাম।
দেরি হল যে! মৃদু কণ্ঠে অশোক রায় এবার প্রশ্ন করে।
বল কেন, বৌদি কোথায় এক পার্টিতে যাবে শাড়ি পছন্দ করে দিতে দিতে—
তা তুমি যে গেলে না?
ভুলে গেলে নাকি, শনিবার আর বুধবার রাত্রে যেখানেই যাই না কেন, রাত দশটায় এখানে আসিই!
ঐ সময় ওয়েটার মীরজুমলা এসে হলঘরের মধ্যে ঢুকল সুদৃশ্য একটা প্লাসটিকের ট্রের উপরে পিপাসীদের বিভিন্ন সব পানীয় গ্লাসে গ্লাসে ভরে। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে সে ট্রে-টা ধরতে লাগল। এক এক করে যে যার নির্দিষ্ট পানীয় মীরজুমলার ইঙ্গিতে তুলে নিতে লাগল ট্রে-র উপর থেকে। মিত্রা সেনকে লিমন-জুসের গ্লাসটা দিয়ে শূন্য ট্রে-টা হাতে এবার এগিয়ে এল মীরজুমলা আমার দিকে এবং আমার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
আমিও তাকালাম লোকটার মুখের দিকে।
তারপরই সুস্পষ্টোচারিত নির্ভুল ইংরাজীতে প্রশ্ন করল, Any drink, Sir?
একজন ওয়েটারের মুখে অমন সুস্পষ্টোচ্চারিত নির্ভুল ইংরাজী শুনে আমিও নিজের অজ্ঞাতেই মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, Yes, Gin and bitter please?
মীরজুমলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে স্থানত্যাগ করল। এবারে স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, চলার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ও গতি আছে লোকটার।
আমি আবার হলের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলাম।
হঠাৎ ছোট একটা কথা কানে এল।
লাকি গ্যায়!
কথাটা বলেছিল বিখ্যাত আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহা তার সামনেই দণ্ডায়মান শ্ৰীমন্ত পালকে।
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সোমেশ্বর একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অল্প দূরেই ঘনিষ্ঠভাবে পাশাপাশি দণ্ডায়মান মিত্রা সেন ও অশোক রায়ের দিকে।
সোমেশ্বরের দু-চোখের তারায় মনে হচ্ছিল যেন একটা কুটিল হিংসা ও সঙ্গে আরও একটা কিছু মিশে আছে।
নিজের অজ্ঞাতেই যেন দৃষ্টিটা আমার সোমেশ্বরের মুখের উপর স্থির হয়ে ছিল। সোমেশ্বরকে ইতিপূর্বে চাক্ষুষ কখনও না দেখলেও ওর আঁকা ছবি দেখেছি। এবং বহু সাময়িক কাগজে ওর অনন্যসাধারণ প্রতিভার সমালোচনা পড়েছি। সেই থেকেই লোকটাকে না দেখলেও মনের মধ্যে ওর প্রতি আমার একটা প্রশংসা ও শ্রদ্ধার ভাব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনও ভাবতে পারিনি লোকটার চেহারা এত কুৎসিত। বেঁটে কালো দেখতে। ছোট কপাল, রোমশ জোড়া জ। নাকটা একটু চাপা। গোল গোল চোখ। একমাত্র হাতের মোটা মোটা কুৎসিত রোমশ আঙুলগুলি ছাড়া দেহের আর সমুদয় অংশ সযত্ন পরিধেয় পোশাকে আবৃত থাকলেও বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটার শরীরে লোমের একটু আধিক্যই আছে।
ভাবছিলাম ঐ লোমশ কুৎসিতদর্শন মোটা মোটা আঙুলগুলো কি করে অমন সাদা কাগজের বুকে সূক্ষ্ম শিল্প রচনা করে! লোকটার চেহারা, চোখের দৃষ্টি ও হাতের আঙুল দেখলেই স্বতই মনে হয় লোকটা নিশ্চয় একটা নৃশংস খুনী। অতবড় উঁচুদরের একজন শিল্পী কোনমতেই নয়।
বিধাতার সৃষ্টি সত্যই আশ্চর্য। নইলে এমন চেহারা ও কাজে এমন বৈচিত্র্য আসে কোথা থেকে আর কোন যুক্তিতেই বা! নিজের চিন্তায় বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম চার নম্বর দরজা-পথে কেউ ক্ষণপূর্বে নিশ্চয়ই প্রস্থান করেছে, দরজার কবাটটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তারপরেই এদিক-ওদিক তাকাতে নজরে পড়ল ঘরের মধ্যে দুটি প্রাণী নেই। অশোক রায় ও মিত্রা সেন। এবং নিজের অজ্ঞাতেই আবার আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ঘুরে গিয়ে পড়ল আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহার মুখের উপরে। দেখলাম সোমেশ্বরের দু-চোখের স্থিরদৃষ্টি সেই চার নম্বরের বন্ধ কবাটের গায়ে যেন পিন দিয়ে কে এঁটে দিয়েছে।
ক্ষণকাল সেই বন্ধ কটের দিকে তাকিয়ে থেকে সোমেশ্বর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চার নম্বর দরজাটা খুলে প্রস্থান করল।
ঘড়িতে ঠিক তখন সাড়ে দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাক।
দুর্নিবার এক আকর্ষণে সেই চার নম্বর দরজাটা আমায় টানছিল এবং নিজের অজ্ঞাতেই একসময় পায়ে পায়ে সেদিকে যে এলিয়েও গিয়েছি টের পাইনি। দরজার কাছাকাছি প্রায় যখন গিয়েছি হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল, মীরজুমলা ট্রে-তে করে আমার পানীয় নিয়ে হলঘরে এসে প্রবেশ করল।
Your drink, Sir!
ট্রে থেকে গ্লাসটা তুলে নিতে নিতে আড়চোখে তাকালাম মীরজুমলার মুখের দিকে। মুখখানা যেন তার পাথরে কোঁদা, কিন্তু চোখের কোণে স্পষ্ট যেন মনে হল একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ-চমক।
মীরজুমলা তিন নম্বর দরজা-পথে বের হয়ে গেল ট্রে-টা হাতে নিয়ে। হলঘরের চারিদিকে আবার দৃষ্টিপাত করলাম। কেউ আমার দিকে চেয়ে আছে কি! কিন্তু না, সকলেই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে কারও যেন হৃক্ষেপও নেই। আমি যে একজন নবাগত তাদের সঙ্ঘে আজ রাত্রে, সে ব্যাপারে কারো মনেই যেন বিন্দুমাত্রও কৌতূহলের উদ্রেক করেনি।